সেজান মাহমুদ : ২০১৫ সালে কী লিখেছি, ২০১৬ সালে কী লিখব
ছোট বেলা থেকে ভাবতাম গল্প লেখা ছাড়া জীবনে আর কিছু করবো না। কিন্তু আমাদের সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা এক রকমের বাধ্য করে অন্য জীবিকা ধারণ করতে। সেই খেসারত তো দিতেই হয়। তাই পরিকল্পনা করি এক রকম, আর হয় আরেক রকম।
২০১৫ সালে অনেকগুলো গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। তারমধ্যে অন্যতম ছিল একটি সিনেমার চিত্রনাট্য। সেই সঙ্গে একটি উপন্যাস যা লেখা শুরু করেছি কয়েক বছর আগেই এবং তা চলছে, একটি স্মৃতিকথা এবং একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। পরিকল্পনা ছিল দিনে-রাতে কম পক্ষে ছয় থেকে আট ঘণ্টা করে লিখবো। সেভাবেই ছক করে নেয়া ছিল।
সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা শেষ করেছি। স্মৃতি কথা শেষ করেছি। উপন্যাসের চারটি অধ্যায় শেষ করেছি। তবে এখানে বলা উচিত সিনেমার গল্পটি লেখাই এক বছরের জন্যে একজন পেশাদার লেখকের পূর্ণ কাজ। কারণ, হলিউডের চিত্রনাট্য লেখা আর আমরা বাংলাদেশে যেভাবে চিত্রনাট্য লিখি তা কোনভাবেই একরকমের না। তাছাড়া ইংরেজিতে লেখা, এবং সমস্ত টেকনিক্যাল বা কারিগরি দিক ঠিক রেখে লেখা ভীষণ রকমের কষ্ঠসাধ্য কাজ। তবে শেষ করেছি এবং দেখা যাচ্ছে টেকনিক্যাল বা কারিগরি দিক একদম ঠিক আছে। গল্প তো ভাল আমি জানিই, এখন প্রশ্ন হলো চলচ্চিত্রে রূপ দেবেন যারা তাঁদের অনেক কিছুর ওপরে নির্ভর করতে হয়। তারপরও বলি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে গল্প বলার ভাষা একেবারেই অন্যরকম। উপন্যাসে যে আঙ্গিক বা ভাষা নিয়ে খেলা একজন লেখক স্বাধীনভাবে করতে পারেন, চলচ্চিত্রে সেই স্বাধীনতা নেই। বরং কিছু স্থির বিষয়ের মধ্যে দৃশ্যকল্প নির্মাণ, সংলাপ, চরিত্রের সামান্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে গল্পটি বলে যেতে হয়। এখানে রাখতে হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সূত্র যা দিয়ে পরিচালক, অভিনেতা, সংগীত, শব্দ পরিচালকেরা খুঁজে নেবেন নিজ নিজ সৃজনশীলতার জায়গা। উপন্যাস লেখার চেয়ে এটা অন্য ধরনের চ্যালেঞ্জ।
না, সব শেষ করা সম্ভব হয় নি। চিত্রনাট্য টি কতে গিয়ে আমার বাংলা লেখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে চিত্রনাট্যটি শেষ করেছি অন্ততপক্ষে পাঁচবার পূর্ণলিখন বা সংস্কারের মধ্য দিয়ে। লিখি কিন্তু মনের মতন হয় না। মনে হয় গল্পটি যেভাবে বলা উচিত তা হয় নি, কিম্বা গল্প বলতে গিয়ে পর্দায় কেমন দৃশ্যায়িত হবে সেদিকটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এরকম দোটানায় বার বার লিখতে হয়েছে। অন্যদিকে উপন্যাসের লেখা ভীষণ রকমের পরিশ্রমসাধ্য। ভাষা নিয়ে সজাগ থেকে, বর্ণণার ধারাবাহিকতা এবং সেইসঙ্গে নিরীক্ষার উপাদানগুলো মিলিয়ে একটি অত্যন্ত সচেতন, গবেষণার কাজের মতো তা।
না। একেবারেই না। মনে হয় আরো সময় করে অল্প লেখা উচিত। আসলে সারাক্ষণ লিখতে পারি না জন্যেই বোধহয় একসঙ্গে অনেক কিছু করতে ইচ্ছা করে। এখানে নিজের সঙ্গে সংযত, সংযমী আচরণ করা জরুরি মনে হচ্ছে। আসলে কোন লেখক কি লিখে তৃপ্ত হতে পারেন কখনো? লেখা তো এক ধরনের মহাকাশের বিশাল শূন্যতায় হাতড়ে বেড়ানো। অসীম সম্ভাবনার মধ্যে কোন একটি রূপ কে ধরে রাখার সামান্য আয়োজন। মনে হয় ছোট ছোট কণা দিয়ে একটি অবয়ব নির্মাণের প্রয়াস যা কখনোও পরিপূর্ণ হবে না। তাই তৃপ্ত হওয়ার প্রশ্ন সেখানেই যেখানে লেখক জানেই না সে কী করছে।
উপন্যাসটি শেষ করবো যতোটুকু পারা যায়। এর মাঝখানে একটি ইংরেজি উপন্যাস লেখা শুরু করেছি। এটারও চার পর্ব লেখা শেষ। আরেকটি শর্ট ফিল্ম বা সিনেমার চিত্র্যনাট্য শেষ করবো। একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি শেষ করবো। এগুলোর অনেকখানি করে লেখা হয়েই আছে। তবে উপন্যাস টি-ই প্রধান কাজ। এটিকে ‘অগ্নিবালক’ উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব বলা যেতে পারে। ধীরে ধীরে তা শেষ করতে চাই যদি বেঁচে থাকি এবং সুস্থ থাকি।
আমি লেখার জন্যে বিস্তর সময় এবং প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। ভাবছি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুদিনের ছুটি নেবো। দিনে রাতে আট থেকে দশ ঘণ্টা লেখার পরিকল্পনা। উপন্যাসের সঙ্গে যুক্ত গবেষণার কাজ করা হয়ে গেছে আগেই। এই কাজগুলো ২০০১৬-১৭ মিলিয়ে করতে চাই। এজন্যে ২০১৭ সালের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটির আবেদন জমা দিয়েছি যাতে করে একসঙ্গে ছয় মাস সময় হাতে পাওয়া যায়।
প্রতিটি নতুন লেখাতেই মনে হয় ভিন্ন কিছু করবো, ভাষা নিয়ে, গল্প বলার ধরন নিয়ে। তবে শুধু গল্পটি বলার চেয়ে কেন তা হলো তা বলার চেষ্টা করবো। অগ্নিবালকের দ্বিতীয় পর্বের নাম “অগ্নিকাল’। এতে কিছু নতুন নিরীক্ষা থাকবে। বাংলাদেশের সাহিত্য সমালোচনায় বা আলোচনায় ম্যাজিক রিয়েলিজম বা সাইকোএনালিসিস নিয়ে পরিষ্কার ধারণা কারো মধ্যেই দেখতে পাই না। এই ট্রিলজিতে এই দুই তাত্ত্বিক বিষয়ের আমার তরফ থেকে একটা পূর্ণ রূপ দিতে চাই। এটাই এই মুহূর্তের বড় পরিবর্তনের পরকল্পনা।