রাজেশ পালের গল্প : বল্লম
মাথার পেছনে খচখচ শব্দ হতেই চমকে ওঠে শফর আলী। একটানা বসে থাকতে থাকতে কেমন জানি তন্দ্রার মতো এসে গিয়েছিল। পেছনে ফেরে দেখে মাচানের নীচ একটা নেড়ি কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। শব্দটা সেখান থেকেই আসা। আসলে পরপর তিন রাত ধরে চড়ে পড়ে আছে তারা। হাবীব বেপারীর দলবলের আর দেখা নেই।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাকে আর দেখতে পেল না শফর। অনেক খোঁজাখুঁজি করলো। কিন্তু কোথাও সন্ধান পেল না। পাশের বাড়ির শামসু চাচার বৌ বলেছিল, “পেটে পাপ বাঁইধা আর মুখ দেহাইব কেমনে? তাই দূর অইয়া গেছে মাগীটা” কিছুই বোঝেনি শফর। আজো বোঝে না। তার কাছে রহস্যই হয়ে রইলো মায়ের এই অন্তর্ধান। মা চলে যাওয়ার পরে শামসু চাচার বাসাতেই বড় হয় শফর। অবশ্য রীতিমতো খরচ পাঠাতো রুস্তম গাজী। শামসু চাচাও কালুর দলের লাঠিয়াল ছিল। তার কাছেই বল্লম ধরা শেখে শফর। সবাই বলতো বাপের মেজাজ পেয়েছে শফর।
হঠাৎ প্রচণ্ড একটা যান্ত্রিক শব্দে চৈতন্য ফেরে শফরের। চরের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে ক্রমশ: এগিয়ে আসছে শব্দটা। হাতের বল্লমে চাপ বাড়ে শফরের। প্রথমে ঠাওর করতে পারেনা কিছুই। একটু পরেই বুঝতে পারে শব্দের উৎসস্থল। গাঙের জল তোলপাড় করে ছুটে আসছে একটা গানবোট। চরের কাছে নোঙর করলো, এরপর নেমে এলো একটা পাটাতন। আর সেই পাটাতন বেয়ে একে একে নেমে এলো জনা বিশেক খাকি পোশাকধারী। সবার হাতেই উদ্যত রাইফেল। মিলিটারি আগেও অনেক দেখেছে শফর। আমজাদ গাজী শহরে গেলেই ছুটে যেতো ক্যান্টনমেন্টে।সাথে থাকতো শফর। তার মালিকের সাথে বেশ দহরম মহরমই দেখেছে সে।
মিলিটারির দলটা কাছাকাছি আসতেই দলের সাথে আমজাদ গাজীকেও দেখতে পেল শফর। পরনে কালো শেরওয়ানী, মাথায় কিস্তি টুপি। কালো চশমা পড়া একজনের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে সে।উদ্যত আমজাদ গাজীকে দেখে মনে হচ্ছে নিতান্ত প্রভুভক্ত ভৃত্যের মতোই।বিনয়ে গলে যাচ্ছে যেন। মাচানের কাছাকাছি এসে ডাক দেয় আমজাদ গাজী। ডাক শুনে নীচে নেমে আসে শফর। বললামটা তখনো হাতে ধরা।ভ্রু কুঁচকে একবার বল্লমটার দিকে, আরেকবার শফরের পেশীবহুল উদোম শরীরটার দিকে তাকাল পাশের কালো চশমা পরা লোকটি।
……… শোন, ইনি ক্যাপ্টেন সাহেব, উনি আর উনার লোকজন কয়েকদিন থাকবেন এই চরে ক্যাম্প করে।উনাদের যেন কোন সমস্যা না হয় , সেদিকে সবসময় খেয়াল রাখবি। আমি রোজ দুবেলা এসে খবরাখবর নিয়ে যাবো।
সেদিনটা কেটে গেল কোন ঝামেলা ছাড়াই , তাঁবু টাঙানো, বালির বস্তা বসানো, এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিল লোকগুলো। পরদিন থেকে যেন নেমে এলো কেয়ামত। গ্রামে হিন্দু পাড়া ছিল দুটো। তাতীপাড়া আর জেলেপাড়া। যদিও কিছুদিন আগে ঢাকায় নাকি কিসব গণ্ডগোল হয়েছে শুনতে পেয়েই এই দুই পাড়ার বেশীরভাগ লোকই গাট্টি বোঁচকা বেঁধে বৌ ছেলের হাত ধরে কোথায় জানি চলে গেছে। আর গেছে এই চরের উপর দিয়েই। মানুষগুলোর উপরে মনে মনে বিরক্তই হয়েছিল শফর আলী। কোথায় ঢাকা, আর কোথায় এই অজ পাড়াগাঁ। আসতে যেতেই তো দুদিন লাগে। আর সেখানে গণ্ডগোল হয়েছে জেনে এখান থেকে চলে যাবে এ কেমনতর কথা? যতোসব ভীরুর দল।
এতো ছিল সবে শুরু মাত্র। এরপর ঘটতে থাকে একের এক নারকীয় ঘটনা। গ্রামের সবার প্রিয় হামিদ মাস্টারকে ধরে আনল আমজাদের লোকেরা।আগে থেকেই মাস্টারের উপরে ক্ষোভ ছিল আমজাদ গাজীর। গাজীর ছেলেকে পরীক্ষায় ফেল করানোর পর থেকেই এই ক্ষোভ পুষে রেখেছিল সে। নিরীহ মানুষটাকে বাজারের মাঝখানে উলঙ্গ করে পেটাতে পেটাতেই মেরে ফেলে ওরা। মুখ দিয়ে সমানে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল মানুষটার। তবে এসব বলে আর কি হবে? এরপর আরো কতোজনইতো এলো আর গেলো। একদিন হঠাৎ অন্যরকম একটা ঘটনা ঘটলো। দুজন খানসেনা গিয়েছিলো গ্রামের বাজারে। ফিরতে একটু দেরী হয়েছিল। পরদিন লাশ দুটো পাওয়া গেল জংলার পাশে।গুলিতে ঝাঁঝরা। সাথের অস্ত্র দুটোও নেই। কিন্তু এদের মারল কারা? তাও আবার গুলি করে? আশেপাশের পাঁচ গ্রামে বেপারী আর গাজীদের দুটো বন্দুক ছাড়া আর কারো কাছে বন্দুক আছে বলেতো জানেনা সে। ভেবে কূল করতে পারেনা শফর।
পরদিন এর বদলা নিতে সারা এলাকায় তাণ্ডব চালায় মিলিটারি। বেশ কিছু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় ওরা। দুপুরের দিকে ৩০/৪০ জনকে মারতে মারতে নিয়ে আশে গাঙের পারে। মসজিদের ইমাম সাহেবও আছেন সেই দলে। সবার চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা। গাঙের হাঁটু-পানিতে নামিয়ে দেয়া হলো সবাইকে। তারপর শুরু হলো এলোপাথাড়ি গুলি। রক্তে লাল হয়ে গেল গাঙের পানি।সব দেখে যাচ্ছে শফর আর করে যাচ্ছে হুকুম তামিল।নিয়ম করে ক্যাপ্টেনের তাঁবু পরিষ্কার করছে, গাজীর পাঠানো গ্রাম থেকে লুট করা মুরগী আর খাসি পৌঁছে দিচ্ছে, গরমে পাখা হাতে বাতাস করছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করে চলেছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে তার দোস্ত বদি শেখের বৌকে বেইজ্জত করে মারার পর থেকে ক্যাপ্টেনের আর আমজাদের উপরে তীব্র একটা ঘৃণা ক্রমশ: বেড়ে উঠেছে নিজেরই অজান্তে।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও রাতে চাচীর বাড়ি গেল শফর রাতের খাবার খেতে। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কেমন যেন খটকা লাগলো তার। সারা বাড়ি অন্ধকার। আলো জ্বালেনি কেন? তেল নেই নাকি? একটু এগোতেই দেখতে পেলো কে যেন পড়ে আছে উঠোনের উপরে। সামনে যেতেই দেখতে পেলো চাচীকে। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। তাড়াতাড়ি পাঁজা কোলে করে চাচীকে বারান্দায় নিয়ে গেলো শফর। কলসি থেকে পানি এনে ঢালতে লাগলো চোখে মুখে। একটু পরে হালকা চোখ মেললেন তিনি।
……… চাচী , ও চাচী, কি অইছে? মাথা ফাটলো কেমনে? মরিয়ম কনে?
শফরকে আঁকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন চাচী।
……… সর্বনাশ অইয়া গেছেরে শফর। মরিয়মরে মিলিটারি তুইল্যা লইয়া গেছে। আমজাদ গাজীর লগে আইছিল। আমি আটকাইতে চাইছি, মাইরা আমার মাথা ফাটাইয়া দিছে। আমার মরিয়মরে আইনা দে বাপ।আমার যে আর কেউ নাই রে।
বলে আবারো জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন তিনি। সেই জ্ঞান আর ফিরল না। পরদিন চাচীর দাফন সারলো শফর আলী একাই। একেবারে নীরব, অবিচল, ভাবলেশহীনভাবে। পাড়ার কয়েকজন সাহায্য করতে এসেছিলো। কিন্তু তাদেরকে কিছুই করতে দিল না সে। এরপর পশ্চিমের মাঠ ধরে সোজা হেটে গেলো সবার সামনে দিয়ে। কাউকে কিছুই বলল না। কই গেলো, কেউ জানেনা।
দিন পাঁচেক পরে নিজের কাছারি ঘরে পাওয়া গেল আমজাদ গাজীর লাশ। বল্লমটা বুক ফেড়ে সোজা মাটিতে গেঁথে আছে অর্ধেকটা। আর উপড়ে ফেলা হয়েছে চোখদুটো। কেটে ফেলা হয়েছে পুরুষাঙ্গটি।
বল্লমটা চিনতে কারো কিন্তু ভুল হলো না