ইউলি ডানিয়েল’এর গল্প : হস্তযুগল
কাকে তুমি ডরাও হে, কেন তুমি কোন প্রশ্ন তোলোনা। অথচ তোমার প্ল্যান্টের বান্দারা, তারা তো সোজাসুজিই বলে দেয়, নাহ ভাসকা, তোমার মদ্যাসক্তি তোমাকে রসাতলে নিয়ে যাবে।
আমি সবকিছু মনে করতে পারছি। আমি তো মাত্রই ড্রিংক নিলাম আমাদের সাক্ষাতের সৌজন্যে। আরে ভাই, মনে করো– কীভাবে আমরা লুকানোর জন্য দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, তুমি সাদা ফরাশি সৈনিকের সাথে কথা বলছিলে, কীভাবে আমরা ইয়ারোস্লাভকে পাকড়াও করেছিলাম। মনে করো কীভাবে তুমি রাজনৈতিক মে বক্তৃতা দিতে উঠে গিয়েছিলে আর আমার হাত ধরে বলে উঠেছিলে, দেখুন ভাইয়েরা আমাদের সংঘবদ্ধ মুষ্টিবদ্ধ বিপ্লবী হাত…
যা হোক, এটা একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা মাত্র, আমি তার কী করতে পারি? ঘটনাগুলো পরপর সাজিয়ে বসে ভাবতে গেলে এখন বুঝি উনিশ’শ একুশের সেই বিজয় বছরেই প্ল্যান্টে ফিরে যাওয়া আমাদের উচিত ছিল। তখন আমাদের নিরস্ত্রীকরণ করা হয়েছিল।
ভালো, যাহোক, একজন বিপ্লবের নায়ক হিসেবে আমার কাছে, এটা পরিষ্কার যে, সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমি পার্টির একজন বিবেকবান দায়িত্বশীল কর্মী ছিলাম। আমি বেশ কিছু সদস্যকে সংগঠিত করেছিলাম, তখন সব ধরনের কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারা বলছিল, যুদ্ধ আমাদের ভাগ্যে কী এনে দিয়েছে? আমরা কী পেয়েছি, না এক টুকরো রুটি, না কিছু। আচ্ছা, ঠিক আছে আমি এসব বলা বন্ধ করছি।
আমি সবসময় শক্ত মনের ছিলাম। তুমি আমাকে মেনশেভিকের ছাগলামি কথাবার্তার মতো বোকা বানাতে পারবে না। যাও আরো ঢালো গিয়ে চোখের পানি, আমার জন্য অপেক্ষা করো না। আমি ঠিক এক বছর অপেক্ষা করব, এর বেশি না, তারপর গুম হয়ে যাব। তারা আমাকে রাইকমে ডেকেছে। এই যে তাদের ভ্রমণ আদেশের কাগজ মালিনিন। তারা বলেছিল, মালিনিন ভাসিলি সেমোনোভিচ, পার্টি তোমাকে প্রতিবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বীরোচিত বিশেষ পদস্থ কমিশনের দলভুক্ত মিশনে পাঠাচ্ছে।
বিদায় জানিয়ে আমি হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম কীভাবে এইসব প্রতি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীনভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে যারা আমাদের তরুণ সোভিয়েত শক্তিকে প্রতিহত করে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। যা হোক, আমি গেলাম সেখানে। সেখানে দেখা হলো জারজিনস্কি, ফেলিক্স এডমানোভিচ সহ অনেকের সাথে। আমি রাইকমের অভ্যাগতদের শুভেচ্ছা বার্তা তাদের পৌঁছে দিলাম। তারা আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সারিবদ্ধভাবে অন্য আরো জনা ত্রিশেক আগত কমরেডের সাথে দাঁড় করিয়ে দিল। আর জিজ্ঞেস করল আমরা জলাভূমির উপর থাকার মতো ঘর বানিয়ে নিতে পারব কিনা।
যা হোক, আমি সেখানে প্রায় সাত মাসের মতো কাজ করেছিলাম। আর তারপরই ঘটনাটা ঘটে গেল। আমাদের উপর নির্দেশ এলো একটা যাজক দলকে শেষ করে দেবার জন্য। প্রতিবিপ্লবিদের ভেতর মিথ্যা অপপ্রচার আর অস্থিরতা সৃষ্টির দায়ে তারা অভিযুক্ত। যাজক শাসিত জেলাগুলোর অধিবাসীরা তাদের প্রচারণায় উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। সম্ভবত এটা ঐ তিখন ব্যাটার জন্যই। অথবা সাধারণভাবে যা মনে হয় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান, আমি ঠিক নিশ্চিত না– এক কথায় শ্রেণীশত্রু আর কি। তারা ছিল সংখ্যায় ডজন খানেক। আমাদের কমান্ডার নির্দেশ দিলেন, যাও , মালিনিন তুমি তিনজনকে তুলে নেবে আর তুমি ভ্ললাসেনকে… আর তুমি গলভশিনের, আর তুমি… আমি চতুর্থজনের নাম ভুলে গেছি। সত্যি কথা বলতে কি সে একজন লাটভিয়ান এটুকু মনে আছে। তার নামটা খুব অদ্ভুত টাইপের ছিল। আমাদের মতো না।
যা হোক, গলভশিনের আর লাটভিয়ান তার কাজ শেষ করে এলো। এখন আমার পালা। আমি বেশ অনেকখানি মদ গিলে নিয়েছিলাম। তার মানে ভেবো না আমি ভীতু বা আমার মনে ধর্মভয় কাজ করে। মোটেই তা না, আমি আমার দলের অনুগত সদস্য, দৃঢ়চিত্ত। আর আমি এসব মূর্খতায় কোনদিন বিশ্বাস রাখিনি। কোন প্রতীক ঈশ্বর, পরকাল বা ফেরেশতা– এইসব হাবিজাবি আর কি। কিন্তু কী আশ্চর্যের বিষয়, ঐ সব বাদ দিয়েও আমার খুব আজব এক অনুভূতি হতে থাকে। এটা গলভশিনেরর জন্য খুব সহজ ছিল। সে একজন জরথুস্ট ধর্মে বিশ্বাসী। তাদের এমনকি কোনো প্রতীকেও পূজা করতে হয় না। অথচ কী আজব বিষয় যে, কাজ শুরুর আগে মদ্যপানের সময় থেকেই মাথার মধ্যে নানা কিছু ঘুরতে থাকে। অর্থহীন সব ব্যাপার আর কি। ছোট বেলার কথা মনে আসে, আমার মৃত মা আমাদের নিয়ে গ্রামের চার্চে যেতেন। আমরা বৃদ্ধ শ্মশ্রুমণ্ডিত ফাদার ভাসিলির হাতে চুমু খেয়ে তাকে সম্বোধন করতাম। তখন তিনিও আমার নাম ধরে ডাকতেন।
আচ্ছা, যা হোক যা বলছিলাম, তারপর আমি ভেতরে গিয়ে একজনকে শেষ করলাম। টেনে বাইরে আনলাম, কাজ শেষ করে একটা সিগারেট ধরলাম। আবার একটাকে খতম করে বাইরে টেনে বের করলাম। একটা ড্রিংক নিলাম। কিন্তু আমি প্রচন্ড অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। পেটের ভেতর প্রবল ব্যথা আর অস্বস্তি। আমি সঙ্গীদের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়ে ওয়াশরুমে বমি করে পরিষ্কার হয়ে এলাম। আমার মাউজার পিস্তলটা টেবিলের উপর রেখে গিয়েছিলাম। আসলে অতিরিক্ত পান করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন তো সব ঠিক আছে। না, একটা চাপা অস্বস্তি এখনো কোথাও আছে। ধুর জাহান্নামে যাক সব। এটাকে শেষ করেই বাসায় ফিরে একটা লম্বা ঘুম দিতে হবে।
আমি তৃতীয়জনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। এই শেষের জন এখনো দেখতে যুবকের মতো দীর্ঘ দেহী সুদর্শন যাজক। আমি তাকে হলের করডোরে অনুসরণ করছিলাম। দেখছিলাম সে কীভাবে তার দীর্ঘ আলখেল্লাটি তুলে ধরে চৌকাঠ ডিঙাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই আবার প্রচন্ড ব্যথা ওঠে পেটে । আমি আমাকে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কখনো তো এমন হয় না । আমরা উঠানের দিকে এগোছিলাম।
যাজক ভদ্রলোক তার দাড়ি মুঠো করে উপরের দিকে তাকালেন। আমি বলে উঠলাম, জায়গায় দাঁড়ান, পেছনে তাকাবেন না, আপনি আপনার সমস্ত প্রার্থনার বিনিময়ে স্বর্গলাভ করতে যাচ্ছেন। আমি এই টান টান উত্তেজনার মুহূর্তেও তামাশা করছিলাম। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এটা আমার জন্য বা ঐ দিনের জন্য স্বাভাবিক ছিল ন। আমি তাকে তিন ধাপ এগিয়ে থাকতে দিলাম যাতে আমার মাউজার পিস্তলটির সাথে তার প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় থাকে।
তুমি তো জানোই একটা মাউজার পিস্তল গুলি বের হওয়ার সময় প্রায় কামানের মতো কাজ করে । বুলেটের ধাক্কায় মানুষটা ছিটকে প্রায় তিন হাত পিছিয়ে যায়। কিন্তু আমি দেখলাম, আমার সাজাপ্রাপ্ত যাজক ঘুরে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। এ রকমটা আর কখনো হয়নি। হয় তারা সশস্ত্র আমাকে দেখে সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নাহলে এলোপাথাড়ি দৌঁড়াতে থাকে। কখনো মাতালের মতো গোঙাতে থাকে। অথচ ইনি ঘুরে দাঁড়ালেন মুখোমুখি এগিয়ে আসতে থাকলেন আর তার লম্বা আলখেল্লাটি যেন বাতাসের ঢেউয়ে ভাসছিল আমি কিছুতেই পিস্তলের লক্ষ্য ঠিক করতে পারছিলাম না । বিরক্ত হয়ে আমি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম, ফাদার আপনি থামুন। কী হচ্ছে এসব ?
আমি আরেকবার মাউজার পিস্তল তাক করলাম। তাক করলাম এবার তার বুক বরাবর। কিন্তু অবাক কান্ড, সে তার জোব্বাটি উদারচিত্তে খুলে মেলে ধরল। তার প্রশস্ত বুকের লোমগুলো ছিল ঘন আর কোঁকড়ানো। সে হাটঁছিল আর চিৎকার করে বলছিল, চালাও গুলি, মারো আমাকে ঘৃণ্য নাস্তিক। তোমার খ্রিস্টের দিব্যি– আসো আর মারো আমাকে।
আমি ঐ মুহূর্ত নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। আমার মাথা কাজ করছিল না। গুলির পর গুলি চালালাম। কিন্তু সে দিব্যি হাটঁছিল। সেখানে কোন রক্ত ছিল না। তাঁর দেহে কোন ক্ষত ছিল না। সে হাঁটছিল আর প্রার্থনা করছিল: ঈশ্বর, এই শয়তানের হাত থেকে তুমি বুলেট কেড়ে নাও। আরো অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল। আমার কার্তুজের ক্লিপ থেকে গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল কিনা তা আমি অনেক করে মনে করতে চেষ্টা করছিলাম। শুধু ভাবছিলাম আমার তো আজ পর্যন্ত কখনো নিশানা ব্যর্থ হয়নি। আমি শূন্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে গুলি করলাম। সে দাঁড়িয়েই ছিল। তার চোখগুলো নেকড়ের মতো জ্বলছিল। তার বুকের পশমগুলো দেখছিলাম। তার চারপাশ থেকে যেন সূর্যের মতো আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। পরমূর্হুতেই বুঝলাম–আমার সামনে অস্তগামী সূর্যটাকে আড়াল করে সে দাঁড়িয়ে ছিল।
তারা আমার কথা বুঝল। আমার কাছ থেকে রাইফেল নিয়ে নিল। তারপর তাড়াতাড়ি হেঁটে অফিসার্স রুমের দিতে এগিয়ে চলল। সেখানে গিয়ে আমি কমরেডদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলাম। ভীত সন্ত্রস্ত উত্তেজিত হয়ে তোঁতলাতে তোঁতলাতে বললাম, আমাকে হত্যা করুন মাননীয় ফেলিক্স এডমান্ডোভিচ, আমি একজন যাজককে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছি। বলেই আমি সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই। পরবর্তী সময়ে আমি নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করি। ডাক্তাররা বলছিল, নার্ভাস ব্রেক ডাউন।
আমি কমিশন (চেকা*) থেকে অব্যাহতির নির্দেশ পেলাম। তাদের প্রয়োজন ছিল কর্মঠ হস্তযুগল। এমনকি আমি আমার লেদ মেশিনের পূর্বেকার কাজেও ফিরে যেতে অক্ষম ছিলাম। এটাইতো স্বাভাবিক। তারা আমাকে প্ল্যান্ট ওয়্যারহাউসে কাজের জন্য নিয়োগ দিয়েছিল। যা হোক, যেমনই হোক কাজ তো। সত্যি কথা বলতে আমি তো আসলে সব ধরনের কাগজপত্র, এমনকি নিজেরগুলোও অনেক সময় দেখভাল করতে পারতাম না। শুধু হাতগুলোর জন্য !
আমার একজন সহকারী ছিল এসব কাজের জন্য, একজন উজ্জল তরূণী। হ্যাঁ বন্ধু, সে জন্যই আজো বেঁচে আছি। আর যাজকের ব্যাপারটা আমি একটু দেরিতে হলেও ধরতে পেরেছিলাম। সেখানে মহত্ত্ব-টহত্ত্ব কিছুই ছিল না। আমি যখন ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম তখন আমার দলীয় সদস্যরা মাউজার পিস্তলটা বদলে একটা বুলেটশূন্য পিস্তল রেখে দেয়। এটা ছিল খুব সাধারণ একটা চাল। আমি তাদের উপর রাগ করিনি, একদমই না। তারা ছিল তরুণ। তাদের স্বপ্ন তখনো সবকিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আহা স্বপ্ন, আহা রাশিয়া! শুধু আমার হাতগুলো!… আর কোন কাজের জন্যই যা উপযুক্ত না।
লেখক পরিচিতি
সোভিয়েত ভিন্নমতালম্বী লেখক ১৯২৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। মৃত্য–১৯৮৮ সালে। তিনি দুটি ছদ্মনামে লিখতেন–Nikolay Arzhak, Yu. Petrov। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। পায়ে মারাত্মক আঘাত পান। তাঁর লেখা সোভিয়েত বিরোধী-এই অভিযোগে শাস্তি হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য শ্রমশিবিরে যেতে হয় ১৯৬৫ সালে। তিনি কবিতা লেখা ছাড়াও দক্ষ অনুবাদক ছিলেন।
অনুবাদক পরিচিতি
রোখসানা চৌধুরী
অনুবাদক। প্রবন্ধকার।
অধ্যাপক।