আগস্তো রোয়া বাসতস্’এর গল্প : জন্মানোর আগে
অনুবাদ : উপল মুখোপাধ্যায়ের
লেখক পরিচিতি :
প্যারাগুয়ের ঔপন্যাসিক ও ছোটো গল্পকার আগস্তো রোয়া বাসতস্ জন্মেছেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে। কিশোর বয়সে তিনি বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ের যুদ্ধে যোগ দেন। পরে তিনি সাংবাদিকতা, সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা ও অধ্যাপনা করেন। Yo el Supremo (I, the Supreme) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই উপন্যাসের জন্য Premio Miguel de Cervantes পুরস্কার পান। এটা লাতিন সাহিত্যের সেরা পুরস্কার। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান।
যখন বললে এত দিন আগের কথা মনে নেই,কারও থাকেও না, এখন তো আর ছেলেমানুষির বয়স নেই। আমি চুপ করে যাই। তবে তা শুধু বাইরেই।
কথা বলার লোকই নেই,,তুমি তো শুনতেই চাইলে না,কী আর করি নিজের সঙ্গেই কথা বলতে থাকি। বাজে না হয় বকলাম না কিন্তু বাজে চুপ থাকা যায় কি? মুখটা দেওয়ালে ঠেকিয়ে নিঃশ্বাসের মতো নিজের বেরিয়ে আসা কথাগুলো বুঝতে চাই, চূনকামের স্বাদ নিই আর বেয়ে ওঠা খয়েরি ছোট ছোট আরশোলাদের একটু একটু করে দাঁতে কেটে ছেড়ে দিই। তারপর আরশোলারা দেওয়াল বেয়ে ছাদের ওপর জমাট বাঁধা অভ্রান্ত মাকড়সার জালে ধরা পড়ে।
চোখের ভেতর দিয়ে যে বাবাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। কল্পনায় বাবার মতো গম্ভীর করি গলা যেন অবিকল একই শোনায়। প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করি আমার জন্মের আগের স্মৃতিগুলোকে ,খুব কিছু মনে পড়ে না। কিন্তু সেগুলো কিছুতেই হারাতে দিই না যাতে তোমায় সেবারের মতো খেপে উঠতে না দেখতে হয়,তোমার চোখে ভালো সাজতে চাই। ওই স্মৃতি তোমায় ফিরিয়ে দিয়ে ভালো লাগাতে চেষ্টা করি যেন বড় পাখিটা তা দিয়ে দিয়ে ছোট ছোট স্মৃতিগুলোকে ফোটাচ্ছে। যখন স্মৃতিদের সঙ্গে একা হয়ে যাই,ওরা যখন অন্ধকারে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে,এক গভীর অসহায়তা ছেয়ে ফেলে আমায়,ভয়ের নয়,বিরাট একাকীত্ব। বড্ড বেশি একা।
যে কিছুতেই ভুলতে পারি না, অন্যমনস্ক থাকলেও বারবার ফিরে আসে।তোমার কাছে যা স্মৃতি আমার
কাছে তা নয়, ওসব তো তোমার জীবনে একবারই ঘটেছে, আমার জন্য তারা রোজই ঘটে, প্রত্যেকবার
একই রকম ভাবে, ঘটতে থাকে । রোজ সকালে সৈন্যরা বাবাকে খুঁজতে আসে, বাবা লুকিয়ে থাকে পাহাড়ের কোলে ।তারা খেপে চিৎকার করে আর রাইফেলের কুঁদো দিয়ে মেরে বাড়িটা তছনছ করে, আলমারিগুলো ভেঙে ফেলে, এমনকি ছোট ড্রয়ারগুলো যেখানে একটা ইঁদুর লুকতে পারে কিনা সন্দেহ, রেহাই পায় না।সেই সময় উঠোনের ওপার থেকে কেউ তাদের বিদ্রূপ করে ওঠে,তারপরই একটা দ্রুতলয় বেয়াড়া গানের চড়া সুর ছেয়ে ফেলে,বাবারই গলায় গাওয়া গান,রাগে ক্ষোভে রুদ্ধ হয়ে আসে স্বর।
ফেলে আর তাদের গুলিগুলো এক ঝাঁক সবুজ পালক উড়িয়ে দেয় তাতে লাল ছিটে লেগে থাকে, টিয়ার মৃত্যু হয়, – তুমি আর আমি দেখি সে কেমন আস্তে আস্তে মাটিতে পড়ে, বন্দুকের ধোঁয়ার মেঘ তাকে ভাসিয়ে রেখেছিল আর সূর্যের আলোর আদরে সে আস্তে আস্তে নামে। এবার কিন্তু সৈন্যরা তোমার দিকে এগোয় , ভয়ানক এক শ্লথ নিশ্চিত গতিতে, তারা তোমার হাত চেপে ধরে,মেরে মাটিতে শোয়াতে যায়,পোশাক তুলে ফেলে,ছিঁড়ে ফেলে। তুমি চিৎকার কর,আছাড়ি পিছাড়ি খাও,চিৎকার কর,কামড়াতে যাও,পা ছোঁড় যেন মরার পরও তোমার চিৎকার চারদিক ছড়িয়ে যাবে। যতবার তুমি বমি করতে যাও,তা আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে ,ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করে ফেলে আমায়,বিলীন হবার শেষ সীমায় পৌঁছে যাই আমি। মনে হয় এ অবস্থা থেকে আর বোধহয় বেরিয়ে আসতে পারব না। ঘোড়ার ক্ষুর বাজে,বাবার ঘোড়াও হতে পারে,আরো লোক আসছে, কোথায় ঘোড়ার নালের আওয়াজ হল,বন্দুকের শব্দ,ঘোড়ার চিঁহিহি ডাক,সূর্যের অশেষ অন্ধকারে কিছুই দেখি না। বাবা পাহাড়ে লুকিয়ে আর কোন দিনই ফিরবে না।
তুমি এসব শুনতে চাও না,আমাকে বল থামতে,বাজে বকা বন্ধ করতে। বলতে থাক বুদ্ধিশুদ্ধির অভাব
বলেই বাজে বকতে বকতে জীবনটাকে শেষ করে ফেলব,ছোট বয়সেই ফুরিয়ে যাব আমি। তোমার ছোট্ট শরীরটা চেঁচায়ঃ শেষবারের মতো বলছি তোকে মানুষ হ। আমি কিন্তু বেশি দিন নেই তখন কী করবি। ওই যে বলে না — মা-মরা বাছুরের দুধ জোটে না। সারাদিন টো টো করে না = ঘুরে গরুগুলো গোয়াল থেকে বের কর।
মধ্যে ঝুঁকে পড়ে পড়ে,কখনও ঝাঁটা ধূলোর মেঘ উড়িয়ে তোমায় আড়াল করে- আর তারপরই তুমি
উঠোনে,বাগানে,ক্রমশ মিলিয়ে ছোট হতে হতে এক ঝলক হাওয়ার মতো কলাঝোপের রোদে ঝলসানো পাতার মধ্যে মিলিয়ে যাও। ঠিক তখনই ড্রামটা নিয়ে গুহার দিকে রওনা দিই, ড্রামের গভীরতম বাদ্যি আর জলের স্রোতের শব্দে ডুবে থাকি। একটা ছোট ফাঁক দিয়ে গুহায় আলো ঢোকে , সেই আলোয় এক নারকেল গাছ এলিয়ে থাকে,নদীর ছোট ছোট ঢেউরা এক বুক আলো নিয়ে আকাশের থেকে মুখ ফেরায়।
যখন ঝড় ওঠে আমি আর কিছু না পেরে জানলার কাঁচটা চাটতে থাকি যতক্ষণ না সারা শরীরে বৃষ্টি আর বজ্রপাতের পোড়া স্বাদ পাই।যখন ভীষণ মেঘের বুকে বাজের গুরু গুরু আওয়াজ ওঠে, আমি জানলার কাঁচ চাটা বন্ধ করি আর ড্রামটা বাজাতে থাকি – বাইরের শব্দের সঙ্গে তাল মেলে না কিছুতেই বেতাল বাদ্যির ঝটকায় আমার আঙ্গুল, হাত আর পেট জুড়ে খিঁচ ধরে যতক্ষণ না বমি শুরু হয়ে সব করে ফেলা ভুলগুলো উগরোয় । আমার যত জঘন্যতম ভুলেরা, আখের রস গেঁজানো ঘন মদের মতো রাতের প্রার্থনা সঙ্গীতঃ ‘আমি পাপী হে’-র সঙ্গে মাথায় ঢুকে পড়ে প্রলাপের মতো বকায় আর ভেতর থেকে উঠে আসা থুথুর সঙ্গে ভগবানের নামটাও বৃথাই দেওয়ালে ছিটিয়ে যায় ।আমার কথা যদি একটু শুনতে কী ভালোই না হত। জন্মের আগের কথা বলতেই সবচেয়ে আনন্দ পাই ওটা চাগিয়ে তোলে আমায়,তোমায় কষ্ট দিতে নয়- বিশ্বাস কর,। শুধু তোমার সঙ্গে থাকতে, মনে হয় আবার তোমার ভেতর ঢুকছি ভিজে একসা হয়ে জঠরের অন্ধকারে। তোমার যাবতীয় উৎকণ্ঠার ওমে জড়িয়ে ধীরে ধীরে মাথার মধ্য অনুভব করি তোমার চলার ছন্দ তা শান্ত করে আমায় যখন বাবার খোঁজে পাহাড়ের পথে চলি। দেখি মনে করতে পারি কিনা।
মৃত্যুতে নাকচ হল লোকটার সারা জীবন বেঁচে থাকাঃ একটা উচ্ছল বেঁচে থাকা,তার রাগগুলো, সৌভাগ্যের চিন্হগুলো,অন্যদের থেকে বেশি জানার সত্যিটা,বেলাগাম আর আমুদেপনায় ভরা জীবন। বেশি সাহসিকতা , সব কিছুই বেশি বেশি রকমের। একটা বিরাট প্রাণবন্ত লোক । কে বিশ্বাস করবে ওই রকম একটা লোক,সারারাত গিটার আর গানের আসর সেরে ফেরার সময় বাদামী ঘোড়াটা থেকে পড়ল আর মরল,একেবারে বাড়ির দোরগোড়ায়। পড়ার সময় গিটারটা ভেঙে যায় । সে শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে আর দূর্ঘটনার কথা জানতে পারি। আমরা দেখলাম লোকটার প্রাণহীন শরীর পড়ে আছে আবর্জনার স্তুপে। বিহ্বল করার মতো দৃশ্য।
আর তো বাবা নেই কথা বলার তাই মৃত মানুষটা সম্বন্ধে যা বলতে চাও শুনি, সে মৃত মানুষটা যে তোমার মধ্যে বার বার মরেই চলে। সেটাই স্বাভাবিকঃ তোমার চোখে যদি তাকে দেখি দেখতে পাব সে তোমায় আনন্দ দিয়ে যায়। আমি কিন্তু তাকে অন্যভাবে দেখি,জানি তাতেই তোমার যত বিরক্তি । মৃত্যুর কথা বলতে বলতে যখন মাথায় আঘাত লাগার কথাটা এল তোমার হাত থেকে আঘাতটা ছুটে আসে আমার মাথায় আর মাথাটা ঠুকে যায় দেওয়ালে,পা থেকে মাথা যন্ত্রণায় কেঁপে ওঠে। যা চাওয়ার তা না চাওয়ার দুঃখ ,আমি যা চাইছি তা তোমায় বোঝাতে না পারার দুঃখ । মাথা ঠোকার সময় দেওয়াল থেকে উঠে আসা পিঁপড়েদের টের পাই,ক্ষুধার্ত ওরা ,আমার মাথা জুড়ে রয়েছে,আর আমি ঠায় দাঁড়িয়ে তোমায় দেখি। ভাবি স্বামীকে খুব ভালোবাসতে বলে আমার জন্যও হয়ত একই মৃত্যু চাইছ যাতে দুজনের প্রতিই অবিচার না করা হয়। এটাই মনে সয় আমাদের তিনজনের জন্য সঠিক । মাথা নিচু করে দাঁড়ালে তুমি আবার না মারলেও হয়ত অন্য কোন আঘাত ছুটে আসবে,আমিই হয়ত নিজের মাথা ঠুকব দেওয়ালে,গাছগুলোয়,ছাগলছানার মতোই আর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাব মাটিতে ,শুধু তোমায় দেখাতে যে আমরা একই ভাবি।
বুঝি স্মৃতির যন্ত্রণা থেকে তুমি মার,তবে অনেক অতীতের কথা ভাবার জন্যই এই মার আমার প্রাপ্য নয়। আমার দোষ আর গ্লানি খুব মনে রাখার মতো কি— ঠিক জানি না। যা সঠিক জানি সে হল আমাকে পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে একই জায়গায় আঘাত করতে হবে,আমার চারপাশ আবদ্ধ ,ভেঙে দিতে হবে জঠরের জলঘেরা চাপ চাপ আকাশ যা পা-টাকে চেপে ধরছে। প্রাণপণে —আকারহীন মাংসপিণ্ডের মতো পৃথিবীর বুকে গড়িয়ে পড়াটা,জন্মানোর আগেই অনাথ হওয়াটা,জীবনকে না জেনেই অপছন্দ করাটা—থামাতেই হবে। তাই আমি তোমার থেকেও ক্লান্ত ,জন্মানোর আগেই আমি তোমার থেকে বড়,মরা বাবার থেকেও বড়,। শহরের সবচেয়ে বয়স্ক লোকটার থেকেও। যখন বলি সব স্মৃতিগুলোই আমার জিম্মায় তোমার বিশ্বাস হয় না কেন ? তুমি বল: যেটার কিছুই জানিস না সে নিয়ে বকেই চলেছিস। আমাকে ও সব নিয়ে বলতে শুনে তোর মনে হলঃ সত্যিই তো ওসব তোর চোখের সামনেই ঘটেছে,যা নিজের সঙ্গে না ঘটছে তা মনে থাকার কথা নয়,বুঝলি। সে সব যুক্তি দিয়ে বুঝতে লাগে।আমি বলি — এত সব করে কি মনে রাখা যায়, এ তো ভুলে যাওয়াই এক রকম। ও সব কথা আমি যুক্তি দিয়ে বুঝতেও চাই না,তুমি তো জানই আমার আধপাগল দশা। নাড়ি বেয়েই স্মৃতিরা ধরা দেয়, চোখ
বুজলেও ওদের দেখিঃ ওরা ওখানেই আছে।
সম্পর্কে একটা কথা বলবি না। লোকটাকে তো চিনলিই না। আর চিনবিই বা কি করে সে যখন মরল তুই তো পেটে , ছমাসের।সে ছিল এক মরদ আর তার গিটারটা ছিল দুই মরদ সমান। সে গাইতে গাইতে প্রকাণ্ড হয়ে স্বর্গ ছুয়ে ফেলত, তার ছায়ায় বসে লোকে তারিয়ে তারিয়ে ভাবত যাক জীবনটা ততো খারাপ নয়। সে গরিবের অধরা সব দামি জিনিস হাতে ধরে মাটিতে নামাতে জানত। তোর মধ্যে তার কণা মাত্র নেই দেখে আফসোসের সীমা নেই রে। সে ঠিকই বুঝেছিল মরাতেই শেষ হবে তার কাজের ধারা।মরার খানিক আগে আমায় দিয়ে দিব্বি করিয়ে নিল – তার সঙ্গে গিটারটাও যেন কবরে যায়। তার শেষ ইচ্ছে আমি পূরণ করেছি।
তুমি কথা রেখেছ। শুধু আমিই বুঝি মৃত মানুষটা,যাকে লোকে আমার বাবা বলে,এসে আমার সঙ্গে থেকে যায় অথচ জায়গাটা দুজনের মতো বড় নয়। আর বুঝি আজ নয় কাল সে এখান থেকে আমায় ঠেলে সরিয়ে ফেলবে। তাই আমি তোমার মার সহ্য করি,বলি না কিছু,তোমার করা অপমানের বোঝা বয়ে চলি,জানি তোমার একমাত্র কাছ হল তার কথাই ভাবা,সেই তো সবচেয়ে পলকা এখন,সবচেয়ে অসহায় ,আমার থেকেও তায় দিকে নজর দেওয়াই এখন কাজ। তোমার দুঃখের ভার কমাতে পাল্লার অন্য দিকে একটা কিছু আমায় চাপাতেই হবে যাতে তোমার দিকে সেটা হেলে পড়ে, ডন লুকাসের দোকানের দাঁড়িপাল্লার মত, তুমি যখন আমায় মুদির দোকানে পাঠাও দেখি একদিকে কালো কালো সিসের বাটখারা রয়েছে অন্য দিকে মুঠো খানেক কফি বা বিস্কুট ফেললে সেটা অন্য দিকে হেলে পড়ে। আমি তোমায় এই দুটুকরো হবার ভারমুক্ত করতে ছাই, যে ভাবে তুমি দুঃখে নুয়ে।কাল যাব সেই ব্রিজের কাছে , ট্রেনের গুম গুম আওয়াজ শুনব।