তাঁর বড় সুবিধা ছিল পাশ্চাত্য সাহিত্যকে তিনি পাঁচ-সাতটা ভাষায় পড়েছিলেন। কিছু গ্রিক ও ল্যাটিনও জানতেন। ফলে তিনি যখন কথা বলতেন আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। যদিও ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ শব্দটি অতিব্যবহারের দোষে দুষ্ট, তারপরও বলতে চাই, সত্যিই আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আর তাঁকে আমি রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করি কয়েকটি কারণে। যেমন—wit ইংরেজি সাহিত্যে আমরা প্রচুর পাই কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তার খুবই অভাব। হাস্যরস আছে কিন্তু ওই যে বুদ্ধিবৃত্তির হাস্যরস যা আমাকে ভাবাবে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বাধ্য করবে—এ বিষয়টি বাংলা সাহিত্যে খুবই কম। অথচ যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয় জানেন তাঁর কৌতুকবোধ সম্পর্কে। দ্বিতীয়টি ছিল তাঁর গল্প, উপন্যাস ও ভ্রমণসাহিত্য। ভ্রমণকাহিনি বর্ণনা করেছেন গল্পের মতন। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, কৌতুকরস আর ভাষার সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি বর্ণনা করে চলছেন, পাঠককে সহযাত্রী করে। অকারণে জ্ঞান দেওয়ার প্রবণতা তাঁর ছিল না।
আমার মতে, বাংলা ভ্রমণসাহিত্য রবীন্দ্রনাথ ও মুজতবা আলী—এ দুজনকে বাদ দিলে একটা শূন্যতার মধ্যে পড়ে যায়। তাই তাঁর এই পরিচ্ছন্ন ভ্রমণসাহিত্যকে অতিক্রম করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, তিনি ছিলেন একজন গল্পকথক। বাংলা ভাষায় আমি দুই ধরনের গল্পধারা দেখি। একটি হচ্ছে গল্প বলা, আর অপরটি গল্প লেখা। আমাদের ঐতিহ্য গল্প বলার আর পশ্চিমের ঐতিহ্য গল্প লেখার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের বহু সাহিত্যিক গল্প লেখার ঐতিহ্যে চলে গেছেন। গল্প লেখাটা আধুনিক ধারা, নতুন। আর গল্প বলার ঐতিহ্য বহু বছরের পুরোনো। সৈয়দ মুজতবা আলী এই গল্পবলার ঐতিহ্যকে গ্রহণ করেছিলেন। তৃতীয়ত, তাঁর মতো ভাষাবিদ তো কমই আছেন। তুলনা করতে গেলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এ—দুজনের কথা বলতে পারি। মুজতবা আলী যে গল্পের বর্ণনা দিতেন তাতে একটা নিটোল গল্প দাঁড়িয়ে যেত। এ তিন বিবেচনায় তিনি, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর একেবারে অদ্বিতীয়।
তিনি সমস্ত বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল পূর্ববঙ্গে (শিলাইদহ ও পতিসর) যে দশ বছর কাটিয়েছিলেন সে সময়টি। নদীবক্ষে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন; উড়িষ্যা গিয়েছেন। আর তাঁর নিজের গড়া শান্তিনিকেতন তো ছিলই। ফলে মাটির সঙ্গে তাঁর অকৃত্রিম একটা যোগাযোগ ছিল। আর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের ঐতিহ্য। বিশ্বকবি তাঁর উপাধি, কিন্তু তাঁর এমন কোনো কবিতা পাওয়া যাবে না যেখানে তিনি ছন্নছাড়া বা শেকড় ছেড়েছেন। আবার যখন বাউলের সংস্কৃতিটা তিনি উপলব্ধি করলেন তখন তার ভেতর আর একটা সমৃদ্ধির জায়গা তৈরি হলো। ফলে রবীন্দ্রনাথকে আমি দেখি একজন নিবেদিতপ্রাণ বাঙালি হিসেবে। তখন তো ভারতীয় আর বাঙালির মধ্যে কোনো তফাত্ ছিল না। ফলে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের ভারতীয়বাদও বাঙালিয়ানা দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত। যেমন : তাঁর ব্রাহ্মসমাজ কিন্তু বাঙালির ধর্ম, এটা ভারতীয় ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্ম যদি এখনো টিকে থাকত তাহলে যে এক-তৃতীয়াংশ হিন্দু আছেন তারা নিজেদের বিশ্বমানব ভাবতে পারত, যা রবীন্দ্রনাথ দেখতে চেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ নাগরিক কবিদের খুব বেশি পছন্দ করতেন না। কারণ তিনি জানতেন, নগর সভ্যতা একটা শেষতম সভ্যতা। তাই যন্ত্রই এখানে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল যদিও যন্ত্র তিনি অপছন্দ করেননি। যন্ত্র ছাড়া চলবে না, সেটাও তিনি জানতেন। কৃষি ব্যবস্থায় যন্ত্র প্রয়োগের নিমিত্তে ছেলে ও মেয়ের জামাইকে পাঠান আমেরিকায় কৃষিবিষয়ক পড়াশোনার জন্যে। ভাবুন, কেমন আধুনিক মানুষ ছিলেন! আবার ছেলেকে বলেছিলেন, ফিরে এসে তুমি বঙ্গীয় কৃষি উন্নয়নে কাজ করবে। পূর্ববঙ্গ থেকে তিনি যা শিখেছেন তা থেকে বেশি কিন্তু আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। কলকাতায় তাঁর জন্ম, নগরে বহুবছর কাটান, কিন্তু তাঁর কবিতায় তাকালে আমরা দেখি—নগরের প্রভাব খুবই সামান্য। যে প্রভাবটি তাঁর কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে তা হলো জনজীবনের প্রভাব। বেশিরভাগ ছোটগল্পই সাধারণ মানুষকে নিয়ে লেখা। জমিদার বা এলিটদের নিয়ে কয়টা লিখেছেন? খুবই কম। ফলে তিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন একদিকে, অথচ তাঁর চিন্তা-চেতনা ছিল ওই মাটিকেন্দ্রিক, যেখান থেকে তিনি উত্সারিত। তাঁর কবিতায় সর্বোপরি আমি একজন খাঁটি বাঙালিকে সবসময় আবিষ্কার করতে পারি।
প্রশ্ন :এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। নীরদ সি চৌধুরীর সঙ্গে তো আপনার একবার দেখা হয়েছিল। পাঠকদের উদ্দেশে এ সম্পর্কে কি কিছু বলবেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : নীরদ সি চৌধুরী একেবারেই ভিন্ন ধরনের একজন মানুষ যাঁকে ব্রাউন সাহেব বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। তাঁর দুটো রূপ। একটি হচ্ছে, তিনি খুব উন্নাসিক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ শাসনকে তিনি একটি ভালো সময় বলে মনে করতেন। ব্রিটিশ সাহিত্য, ইউরোপীয় চিন্তা-চেতনা তাঁকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছিল। বিটোফেনের সংগীতকে আমাদের রাগসংগীত থেকেও তিনি অনেক বেশি মূল্যায়ন করতেন। শরত্ বসুর প্রাইভেট সেক্রেটারি থাকায় সমকালীন রাজনীতিকেও তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আমি অনেকটা স্বইচ্ছায়ই এ লোকটার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তাঁর সম্পর্কে এত নিন্দাবাদ শুনেছি, তাই আগ্রহও বেড়েছে তাঁর সাথে কথা বলার। দু-দিনে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল।
প্রথম দিন আমার নেপালি বন্ধুকে সঙ্গে করে নেয়ায় আমাকে খুব বকাঝকা করলেন। প্রথমে যখন ফোন করলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে, জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় বাড়ি? বললাম, সিলেটে। বললেন, আচ্ছা, আমার বাড়ি কিশোরগঞ্জে আর আপনার বাড়ি সিলেটে। খালের এপার আর ওপার। তা আমার সঙ্গে ছাপার অক্ষরে কথা বলছেন কেন? ভাবিনি, এমন একজন বিদগ্ধ মানুষ প্রথম দেখাতেই আমাকে এত আপন করে নেবেন। মূলত আমি যখন সাক্ষাত্কার নিতে গিয়েছিলাম তখন আমার বয়স তাঁর অর্ধেক। সত্যিকার অর্থে দেশি ভাবটা তাঁর ভেতর আমি এত বেশি দেখতে পেলাম যে অবাক না হয়ে পারলাম না। পরে বুঝলাম, চারদিকের হীনতা, কপটতা ইত্যাদির বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে তাঁর ভেতরে উন্নাসিকতার জন্ম নিয়েছিল।
আর আমার একটা ধারণা—তিনি খাটো মানুষ ছিলেন, বহুদিন চাকরি পাননি। হয়তো বহু অবহেলারও শিকার হয়েছিলেন। তাঁর মতো একজন রুচিশীল মানুষ অথচ চারপাশে এত অরুচির ছড়াছড়ি, তাই হয়তো পশ্চিমা গান শুনতেন। তাহলে তো এমনিতেই তাঁর চারপাশের জগতের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। বিয়ের দিন রাতে তাঁর বউকে মিলটনের বা কার যেন কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন। তাঁর আত্মজীবনীতে আছে। নিশ্চয় এ ঘটনা দেখে যদি তাঁর স্ত্রী দাঁড়িয়ে থাকতেন তবে পড়ে যাওয়ার কথা। এতকিছুর পরও আমি বলব, তিনি অসাধারণ একজন স্বামী ও বাবা ছিলেন। সন্তানদের মানুষ করেছেন। স্ত্রীকে যথেষ্ট সেবা করেছেন। তাই বাবা হিসেবে, স্বামী হিসেবে আমি বলব তিনি সার্থক। তখন তাঁকে নিন্দা করার মতো এত তথ্য-প্রমাণাদি আমার কাছে আর থাকল না। অনেক মানুষ অনেক কিছু বলেন, কিন্তু আমি দেখলাম, সামপ্রদায়িকতার কোনো চিহ্ন তাঁর মধ্যে নেই। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ছিলেন কলিম শরাফী।
কথার মাঝে মাঝে তাঁকে আমি একটু খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। খোঁচা দিয়ে কথা বলায় তিনি দেখলেন যে, এ লোকের সঙ্গে তো মজা করা যায়। তখন দেখলাম তাঁর ভেতর হাস্যরসও আছে। কেউ কিন্তু এ কথাটি বলেননি যে তাঁর ভেতর হাস্যরস আছে। আমি বললাম, হ্যাঁ, আপনি তো ম্যাকলের ভাবশিষ্য। আমাকে বললেন, আপনি ম্যাকলের কয়টা পড়েছেন! আমি বললাম, ম্যাকলেকে পড়েই তো আপনার সঙ্গে তর্ক করতে এসেছি। তখন বললেন, ম্যাকলের ভাবশিষ্য হওয়াটা কি খারাপ? আমি বললাম, ব্রাউন সাহেব হওয়ার কায়দাটা কী? কিছুক্ষণ পরে বললেন, আপনি তো আমাকে প্রভোক (Provoke) করতে এসেছেন, তাই না? পারবেন না। কারণ নীরদ চৌধুরী আপনার থেকে আরো বড় বড় মানুষের খোঁচা খেয়ে হজম করেছে। আমি যা বিশ্বাস করি, তা করিই। এত কথা বলছিলেন কিন্তু কোনো রাগ ছিল না তাঁর মধ্যে। যে মানুষ রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, যে মানুষ তার অর্ধেক বয়সী মানুষের সঙ্গে হু হু করে হাসতে পারেন, যে মানুষ একজন তরুণের খোঁচা খেয়ে হজম করতে পারেন, সে মানুষকে নিন্দা করার আমি কোনো কারণ দেখি না।
আমাদের তাঁকে পড়াশোনা করার, বোঝা বা জানার ভুল থাকতে পারে। ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় আমাকে উত্সর্গ করে হাতে লিখলেন—আমার হুবহু মনে নেই তবে কথাটি এরকম—এতদিনে জানলাম আমি আরেকটা ঘরের অধিবাসী। এ কথাটা ব্রাউন সাহেবরূপী নীরদ সি চৌধুরী বলতে পারতেন না, এ কথাটি কিশোরগঞ্জের নীরদ সি চৌধুরীর। ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’-এ তিনি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ভাষার একটা কারুকাজে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বাঙালিয়ানা ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি নীরদ চৌধুরীর এ কথাটিকে মেনে নিই না। এটা তাঁর ব্যক্তিগত পঠনের একটা প্রতিফলন। তবে আত্মঘাতী বাঙালিতে তিনি যা বলেছেন তা আমি মানি।
[Note: থমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলে (Thomas Babington Macaulay) একজন ব্রিটিশ কবি, ইতিহাসবিদ ও রাজনীতিক ছিলেন]