কান্তারভূষণ নন্দীর গল্পঃ একটা কাটা-হাত
চারদিকে ছোটো ছোটো জটলা। একটা জটলার কেন্দ্রে পুলিশ অফিসার, পেট মোটা। মুখে, ঘাড়ে দুর্বিনীত চর্বি, কষ বেয়ে তাম্বুলের রস। পাশের চেয়ারে সার্কল অফিসার রামপ্রকাশ দ্বিবেদি। বেঁটেখাটো
পাতলা চেহারা। নির্ভুল শেভ। চশমার ফ্রেমে সকালের স্বচ্ছ আলো।
বিনয়কে দেখে নিঃশব্দে হাসলেন,
পরে হিন্দিতে বললেন—আরে, আপনিও? বিনয় অপ্রস্তুত হয় সামান্য। “আপনিও” কথাটার মানে কি এই যে, ঠিক এখানে, একটা আস্ত কাটা-হাত পাওয়া গেছে যেখানে, বিনয়ের সেখানে থাকার কথা ছিল না? অথবা, আরও সোজাসুজি বললে, থাকা উচিত হয়নি? দ্বিবেদি একটা চেয়ার, কার জন্য রাখা ছিল বলা মুশকিল, হাতের মৃদু ধাক্কায় একটুখানি এগিয়ে দিয়ে বললেন—বসুন।
ঈষৎ প্রসারিত করল শুকনোভাবে। সেনসাসের সময় কলেজের আরও কয়েকজন প্রফেসরের সঙ্গে
বিনয়কেও মাস্টার ট্রেনারের ডিউটি করতে হয়েছে। পরে এরকমই দু-একটা কাজে দ্বিবেদি তাকে
ডেকেছিলেন। সেই থেকে পরিচয়। বেলসিরি নদীটা এই মুহূর্তে তার খুব কাছে। জল কম, রোগাটে ধরন।
বাড়ছে। দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে মানুষ এসেই চলেছে। আট মাইল দূর থেকে বিনয়ও এসেছে সুইফটে
করে। ভেতরটা তার এখনও ধুকপুক করছে। ধুকপুকুনি শুরু হয়েছে আনোরার মুখে খবরটা শোনার পর থেকেই। এর আগে থেকেও হতে পারে অবশ্য। গুয়াহাটিতে বসে যেদিন কোকরাঝাড়ের দাঙ্গার খবর পেয়েছিল, হয়তো সেদিন থেকে। টেনশন হলে বিনয় দরদর করে ঘামতে থাকে। হাফ-হাতা পাঞ্জাবিটা খন ভিজে লেপটে আছে তার রোমশ শরীরে। রুমাল দিয়ে ঘাড়-কপাল-গলা মুছল বিনয়। টেনশন হলে বিনয় ঘামে, আর সিগারেটে পরপর লম্বা টান দেয় অনিবার্য বাধ্যতায়। আজ সকাল সাড়ে ছটাতেই তার প্রথম সিগারেট, বাধ্য হয়ে। অর্পিতার হেল্পার আনোরা ঘরে ঢুকেই মেঝেতে ধপাস করে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে শুরু করেছে এক্কেবারে সাতসকালেই। বিনয়দের বাড়িতে ‘ঝি’, ‘কাজের মেয়ে বলা নিষেধ, পরিচারিকা বা হেল্পার। তা অর্পিতা সকালের প্রথম কাপে চুমুক দিতেই যাচ্ছিল, আনোরার কাণ্ড দেখে সে থম মেরে ছবি। বাথরুম সেরে বেরিয়ে, বিনয়ও। আনোরার ফোঁপানোর কারণটি জানতে সময় লাগেনি। নদীতে মাছ মারতে গিয়েছিল বুড়ো জেলে বশির। তার জালে উঠে এসেছে মানুষের হাত।
—জালাল গো বউদি, জালাল। হেইডা বড়ো মাইনষের হাত। জালাল ছাড়া কেডা অইব কয়েন তো?
শুধু অর্পিতা নয়, বিনয়ও কেঁপে উঠেছিল আমূল। রক্ষে তিতলি আর রাজা এই সময় অঘোরে ঘুমোয়।
অর্পিতা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল আনোরাকে, কাটা-হাতটা যে জালালের তার কী মানে। জালালরা যে
মারা গেছে বা তাদের মেরে ফেলা হয়েছে তার তো কোনা প্রমাণ নেই। একদিন হয়তো জালালরা তিনজনই আবার ফিরে আসবে সুস্থ শরীরে। আনোরার কান্না থামে না– না গো বউদি, তারারে মাইরালসে।
ঘটেনি এখনও, কিন্তু ফিসফাস, গুঞ্জন ও গুজব ছিলই। দিন সাতেক আগে ধবলপুরে গিয়ে জালালদের
নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় আতঙ্ক ঘন হয়ে এল নয়ানজুলিতে। জালাল আনোরার দূর সম্পর্কের
ভাইপো। উনিশ- কুড়ির জোয়ান গাট্টাগোট্টা ছেলে। বারো-তেরো বছরের কাগজকুড়ুনি দুটো ছেলের সঙ্গে
গেছিল ধবলপুরে। আর ফেরেনি। পুলিশ দৌড়ঝাঁপ করেছিল প্রথমদিকে, এখন হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছে।
কাছাকাছি হলেও, আজও দুর্গম, রহস্যময়। মাইলের পর মাইল গহন অরণ্য আর সেখানে নাকি হাজার
হাজার উগ্রপন্থীর ঘাঁটি। সাধারণ মানুষ দূরে থাক, আর্মিও সেই জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতে ভয় পায়। খুব
প্রয়োজন না হলে ধবলপুরের দিকে দিনের বেলাতেও কেউ যায় না। ছোটো একটা রেলস্টেশন আছে।
আগে বাধ্য হলে মানুষ যেত, আজকাল আর যায় না। বিনয়ও গেছে দু-একবার। বিনয় স্বীকার করতে
বাধ্য, ধবলপুরের ঠান্ডা নৈঃশব্দ্য তাকে ভীত, শিহরিত করেছিল, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু
জালাল আর কাগজকুড়ুনি ছেলেদুটো যে ধবলপুরেই গেছে কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না, তবু আতঙ্কটা
ছড়াচ্ছে। চারদিকে ফিসফাস ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে, দাঙ্গার আগুন নয়ানজুলিকেও এবার গ্রাস
করবে।
আনোরার গলায় হাহাকার আর হুংকার মিলেমিশে একাকার।
কলেজেই পড়েছে। বিনয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র, পাসকোর্সের। এহসান বিনয়কে বেশ ভক্তি-শ্রদ্ধা
করে।কলেজে শিক্ষক হয়ে ঢুকে প্রথম প্রথম অভ্যেসমতো বিনয়কে স্যার বলে ডাকত। বিনয়ই বলেছে বিনয়দা বা সরকারদা ডাকতে। সেই থেকে সরকারদা। এহসানকে জালালের কথা জিজ্ঞেস করতে হবে।
এখেত আমার কলেজের প্রফেসর সরকার। তারপর বিনয়ের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে-বিনয়ভূষণ, না?
কাকতি বিনয়ের চোখে চোখ রাখলেন কয়েক সেকেন্ড, ঠান্ডাভাবে। বিনয় অস্বস্তিবোধ করল।
ছোটোবেলা থেকেই পুলিশকে দেখলে একটা শিরশিরানি অনুভব করে, সমস্ত কোষে কোষে। সাধারণ
কনস্টেবল হলেও, একইভাবে। বিনয় অস্থির চোখে এহসানকে খোঁজে, আর পেয়েও যায়। বিনয় এগিয়ে গেল এহসানের দিকে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো ফ্রেমের চশমা, উড়নচণ্ডী চুলের এহসান
তাদের পাশ দিয়ে দৌড়ে গেল উত্তেজিতভাবে, বিনয়কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে। দুজনে সরে গেল একটু দূরে।
বিনয় পকেট থেকে সিগারেট বের করে এহসানের দিকে এগিয়ে দিল। এহসান এদিক-ওদিক তাকিয়ে
বলল—থাক।
বানেশ্বর ব্রহ্ম জিওগ্রাফি পড়ায়। বয়সে বিনয় আর এহসানের ঠিক মাঝখানে। বানেশ্বরের রতনজুলির
বাড়িতে তারা তিনজনে মিলে অনেকদিন মদ খেয়েছে। বানেশ্বরের বউ হিরা বাড়িতেই জউ বানায়। হিরাও মাঝে মধ্যে তাদের সঙ্গ দেয়।
বাঁশি বাজাবে। অচেনা সুর নিতান্তই, তবে মাদকতা আছে। বানেশ্বর দারুণ বাজায়। বানেশ্বরের সঙ্গে সে প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছে। বানেশ্বরকে সবাই চেনে। সবার সঙ্গে সে কথা বলে, বাচ্চা থেকে
বুড়ো। পরিচয় দিলে, বিনয় আর এহসানের সঙ্গে ভাঙা অসমিয়াতে কথা বলার চেষ্টা করেছে অনেকে।
তবু, বিনয় ভেবে দেখেছে, ওই অচেনা, নিদারুণ গ্রাম্য পরিবেশ তার মধ্যে একটা অস্বস্তির জন্ম
দিয়েছে। একই অবস্থা তার হয়েছে এহসানের সঙ্গে চর অঞ্চলে বেড়াতে গিয়েও। অকারণ অথচ
অনিবার্য ভয়কে জয় করতেই কি সে তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই ভ্রমণে যেতে চায়? বানেশ্বর আর
এহসান কি বোঝে ব্যাপারটা? হয়তো বোঝে। অন্তত এহসান নিশ্চয়ই। বুদ্ধিমান ছেলে। বানেশ্বরকে
একটু বোকা ধরনের মনে হয়। নাও হতে পারে অবশ্য। মুখ-মুখোশ বোঝা খুব কঠিন। এহসানের
ক্ষেত্রেও উলটোটা হতে পারে। বিনয় কাউকে কোনোদিন ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারে না। অর্পিতা,
তিতলি, রাজা, এমনকী আনোরাকেও। এতে ভয় বেড়ে যায় তার, বোঝে বিনয়, কিন্তু কাউকে বুঝতে না
পারাটা তো তার হাতে নেই। এই অসহনীয় দাঙ্গা-পরিস্থিতি যেমন। কে, কোথায়, কখন এবং কার দ্বারা
আক্রান্ত হবে কেউ জানে না।
বানেশ্বর আর এহসান পাশাপাশি চেয়ারে নিচু গলায় গল্পে মশগুল ছিল, তাই দেখেনি, কিন্তু বিনয় ঠিক
দেখেছিল, সেইমুহূর্তে ভাইস প্রিন্সিপালের রুমে উপস্থিত সব ক-টি চোখ ঘুরে গিয়েছিল তাদের দিকে।
— সরকারদা, বসবেন নাকি কোথাও?
জল মাড়িয়ে যাচ্ছে কয়েকশো আতঙ্কিত, ক্রুদ্ধ পা। টুসকি মেরে সিগারেটের শেষাংশ শূন্যে ছুড়ে দিয়ে, এহসান শুনতে পায় শুধু এমন শব্দে, প্রায় নিঃশব্দেই বলতে গেলে বিনয় বলল— কাটা-হাতটা, এহসান?
এমনিভাবে চমকে ওঠার ঢঙে এহসান বলল—কাটা-হাত? ও হ্যাঁ। মনে হচ্ছে দূরের ওই বড়ো ভিড়টায়।
যাবেন নাকি? থাক না হয়, যা শুনছি…।
পেছন। ভিড়ের কাছে যেতেই বিনয় হৃৎপিণ্ডের দুলুনি টের পেল। বরফজল নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে।
ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি গলাতে চাইল। এহসান বোধহয় এতক্ষণে ভেতরে ঢুকে গেছে। ও পারবে। লোকাল ছেলে।
প্রয়োজন নেই, সে নীল শার্টকে টার্গেট করল। কমবয়সি ছেলে, সফট টার্গেট এবং কাজও হল। কয়েক
জোড়া বিষচোখ তাকে হালকাভাবে দেখে নিয়ে স্বস্থানে ফিরে গেল। শুধু নীল শার্ট বলল—ওই
মাদারচোদ। ৷ বিনয় উদাসীন হয়ে ঘষটে ঘষটে ভেতরে ঢুকে গেল। স্পষ্টতই হাঁটু কাঁপল তার।
ধুকপুকুনিটা আরও স্পষ্ট হল। গলার ভেতরে একটা আস্ত মরুভূমি। নয়-দশ বছরের একটা ছেলে ভ্যাক করে কেঁদে ফেলল। দ্রুত ছিটকে বেরিয়ে এল বিনয়। হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। কাঁধের পাঁচ ইঞ্চি খানেক নীচে এবড়ো খেবড়ো করে কাটা তামাটে হাতটা বড়ো বেশি জ্যান্ত। জল-ঘাসে ভেজা, নির্লোম, বেঁটে বেঁটে আঙুলে বড়ো বড়ো নখ, কবজির কাছে একটা কাটা-দাগ। স্বাস্থ্যবান হাত,নাকি জলে থেকে থেকে পচেফুলেফেঁপে ওঠা বোঝা মুশকিল। জলে ভেসে আসা একটা কাটা হাত সম্পর্কে কোনো কথাই নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না।
—তারাই করসে রে।
একটা জটলার ভেতরে থেকে ছিটকে আসা মন্তব্য।
—ঠিক কইস, তারাই মারসে।
সমর্থনের কণ্ঠ জোগাল কেউ। বিনয় কান পেতে সব শব্দ, বাক্য, কমা-দাঁড়িসেমিকোলনসহ বোঝার
চেষ্টা করল।
—আমাগো জালাল রে।
—কী বা জানস?
—হাতটা দেখছ? বড়ো মাইনসের হাত। লগের দুইটা তো বাইচ্চা ছেলে, অদের হাত হইতনা।
—এহ, হাত দেইখ্যাই চিন্যালাইস। বালের আলাপ কইরনা মিয়া।
বাদ-প্রতিবাদের গুনগুনানি বিনয়ের বুকের ধুকপুকুনিকে সচল রেখেছে। অসহায়ভাবে চোখ তুলে বিনয় এহসানকে খুঁজতে লাগল। দেখল, এহসান গলা উঁচিয়ে তাকেই খুঁজছে। মোবাইল থেকে ফোন করবে ভেবেও করল না বিনয়, চিৎকার করে ডাকলও না, শুধু ডান হাতটা ওঠাল। এহসান হাতটা দেখতে পেয়েছে।
চোখাচোখি হতেই বিনয় দ্রুত চোখ নামাল। বিনয়ের পরনে অনুজ্জ্বল সাদা পাঞ্জাবি , পাজামাও কিছুটা
কোঁচকানো, এখন মাটি আর ঘাস লেগে অতি সাধারণই লাগছে। ক্ষয়াটে-ক্লান্ত চটি, দু-দিনের কাঁচা-
পাকা দাড়ি গালে—বিশেষত্বহীন ভিড়ের একজনই মনে হল নিজেকে। এবার কিছুটা স্বস্তি অনুভব
করলেও সিগারেট ধরাতে গিয়ে তিনটে কাঠি নষ্ট করল বিনয়ের অশক্ত, নড়বড়ে আঙুল। চার নম্বরটি
অবশ্য ঠিকঠাক।
ধরাল,প্রথম কাঠিতেই। গলগলে ধোঁয়া ছেড়ে বলল—ইস্ দেখা যায় না। পুলিশ এতক্ষণ হাতটা ফেলে
রেখেছে কেন বুঝতে পারছিনা। যতক্ষণ থাকবে উত্তেজনা বেড়েই যাবে।
ঠিকই বলেছে এহসান। বিনয় লক্ষ করল, যত সময় যাচ্ছে, মানুষ বাড়ছে আর শব্দ, বাক্যগুলো
ঝাঁঝালো হচ্ছে ক্রমশ। সত্য-মিথ্যা, গুজব, গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, পালটা
লড়াই, ফোঁপানি—অদ্ভুত কোরাস ভেসে আসছে ভিন্ন ভিন্ন জটলা থেকে। এহসানের হাঁটুতে আলতো
হাত রেখে বিনয় বলল—তোমার মত কী এহসান?
—কী ব্যাপারে?
এহসান খানিকটা অন্যমনস্ক যেন।
¬—এই কাটা-হাতের ব্যাপারে।
¬—কী বলব বলুন?
এহসান ঠোট ওলটাল। সত্যি কিছু ভাবেনি এহসান, নাকি তার সঙ্গে আলােচনা করতে চাইছে না, বিনয়
ধরতে পারে না।
—এই যে সবাই বলছে জালালের হাত? তুমি জালালকে চেন?
এহসান শূন্যে অনির্দিষ্ট তাকায়। উত্তর দেয় না। কেউ কাউকে কিছু বলে না, কিন্তু দুজনে একইসঙ্গে
উঠে দাঁড়াল। রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করল।
—কাটা-হাত লইয়া কী করবি রে পুঙ্গির পুত?
যে বলল, একটা পাথরে ঠেস দিয়ে বসে সে পাঁউরুটি চিবোচ্ছে। শতচ্ছিন্ন ফতুয়া আর বারমুডা পরনে,
দাড়ি-গোঁফ বেয়ে তরল শিকনির ধারা। এই পরিবেশেও ফিচেল ছোকরারা পেছনে লেগেছে। ছেলেরা তাকে কিছুএকটা বলতেই লোকটা চিৎকার করে উঠল—মাইনসে মারছে? আমার লাওড়া চোদা, মাছে খাইসে।
এই প্রথম এসহানের ঠোঁটে হাসির আভাস দেখতে পেল বিনয়। সে-ও হাসার চেষ্টা করল। গাড়িতে
বসে বিনয় বলল–কলেজে যাবে না? ক-টায় ক্লাস?
—সাড়ে দশটা। তবে আগেই যাব।
—আমিও। আজ অনেক ক্লাস। ডিপার্টমেন্টাল মিটিংও আছে।
এসবই কেজো কথা। সেজন্যই গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে না। শেষে বলেই ফেলল বিনয়—হ্যাঁ রে এহসান,
আমাদের নয়ানজুলিতে আবার দাঙ্গা-টাঙ্গা হবে না তো? ভয়ই করে আজকাল।
এহসান চোয়াল শক্ত করে বলল—কী করে বলি? তবে পরিস্থিতি কিন্তু মোটেই সুবিধের নয়। চলি
সরকারদা।
স্টিয়ারিঙের ওপর রাখা বিনয়ের অভিজ্ঞ হাত সামান্য কেঁপে উঠল। চটির বাইরে মুখ বের করে থাকা
নিজের পায়ের আঙুলগুলোকে দেখল বিনয়। দৃষ্টি আঙুল থেকে হাঁটু হয়ে বুক অবধি আনল, তারপর আর নিজেকে দেখতে পেল না। মগজে-রক্তে-ঘামে বীর্যে ঠিক কতটা অন্ধকার জমা হলে মানুষ এমন
প্যারানয়েড হতে পারে, বিনয় বুঝে উঠতে পারে না।
সাতসকালেই অর্পিতা আর তিতলি টিভির সামনে। আজ, সঙ্গে আনোরাও। অর্পিতা আর আনোরার
চোখে-মুখে টেনশন। আনোরা বোধহয় ঝাড়ু দিচ্ছিল, সেই ঝাড়ু এখন লাঠির মতো করে ধরা, ভীষণরকম ক্রুদ্ধ। বিনয় দূরে চেয়ার টেনে নিয়ে টিভিতে চোখ রাখল। শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করতে কোনো এক বিধায়ক এসেছিলেন,শরণার্থী শিবিরের মানুষরা তাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছে। বিধায়ক হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠছেন। টিভিতে হত্যা, আগুন। দুবৃত্তেরা বাস থেকে নামিয়ে তিনজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। নদীতে লাশ ভেসে যেতে দেখা গেছে। চলমান দৃশ্যের নীচে লালরঙের খবর দ্রুত আসছে আর সরে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর মৃদু অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার পর্যাপ্ত ফোর্স পাঠাচ্ছে না।
চ্যানেলেও—লাল-কমলা আগুন। পঁচিশ-তিরিশটা বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি কিন্তু
নিয়ন্ত্রণে।
অর্পিতা কোন ফাঁকে গিয়ে চা নিয়ে এসেছে বিনয় টের পায়নি। চায়ে চুমুক দিয়ে তিতলির দিকে তাকাল।
তিতলিও বাঁদিকের কাঁধে মাথা পুরোটা হেলিয়ে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে, হাসল। বিনয়ও।
পরমুহূর্তেই তিতলির চোখ আবার টিভিতে। পাঁচ বছরের তিতলি স্পেশাল চাইল্ড। ট্রাইসোমি টুয়েন্টি
ওয়ান। তার হাতের তালুকে ঠিক মাঝখানে চিরে দিয়ে গেছে একটা গভীর রেখা। কপাল আর নাকের
সংযোগস্থল বেঢপ রকমের সমতলভূমি।
অমিয়ভূষণ সাহা। বিনয়ের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারছিল না পেশাদার চোখ। জন্মের পর
তিতলিকে প্রথম ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে গিয়েছিল বিনয় আর অর্পিতা। অর্পিতাকে চেম্বারের বাইরে
পাঠিয়ে, বিনয়ের কাঁধে ঘনিষ্ঠ হাত রেখে ডক্টর সাহা গলা নামিয়ে বলেছিলেন—স্পেশাল চাইল্ড
মিস্টার সরকার। কিছু করার নেই, স্যরি। তারপর কান্নাকাটি, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, আবোল
তাবোল ডাক্তার, তাবিজ কবচ-রত্নের দীর্ঘ পর্ব গেছে। এরপর মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার পালা।
তারপর থেকে অর্পিতা ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। সেইসঙ্গে রাজাকে ঘিরে লাফিয়ে লাফিয়ে
বেড়েছে অর্পিতার স্বপ্ন আর দুশ্চিন্তা। বিনয়ের বেড়েছে ভয়।
ঘরবাড়ি পুড়ছে সারি সারি। কান্নার রোল উঠেছে। ক্যামেরা জুম করে লাল আগুনকে ধরেছে। টিভিস্ক্রিন এখন পুরোপুরি লাল। অর্পিতার মোবাইলে, এ কী লাবণ্য, ঠিক তক্ষুনি। অর্পিতা টিভির দৃশ্যগুলিকে হুহু ঢেলে দিচ্ছে ফোনে। বিনয় প্রথমেই বুঝেছে-দীক্ষার ফোন, কলকাতা থেকে। দীক্ষা অর্পিতার পিসতুতাে বোন— কবি ও জ্যোতিষী। খবরের কাগজে, টিভির নিউজে অসমের খবর পেয়ে উদবিগ্ন। অর্পিতা বলছে— নয়ানজুলি এখনও ঠিক আছে বুঝলি, কিন্তু টেনশন আছে।…হ্যাঁ, প্রচুর মরেছে… লাশ ভেসে যাচ্ছে নদীতে, শুনেছি…কী বললি আমরা কোন দিকে?
অর্পিতা ডান হাত দিয়ে মোবাইলটা চেপে ধরে বিনয়ের দিকে ফিরে বলল— দীক্ষা বলছে আমরা
কোনদিকে?
একটু অন্যরকমভাবে দীক্ষা আমরা-ওরা খেলছে। দীক্ষা ঘন ঘন দল আর রং বদলায়। আগে সরকারের
পক্ষে ছিল, এখনও সরকারের পক্ষে। বিনয় দাঁতে দাঁত চেপে একটা গালি গলায় আটকে দিল। ওগরানো যাবে না—এটা চরম হতাশার।
—দীক্ষাকে বলো আমরা প্রেমের পক্ষে, শান্তির পক্ষে। বলেই মনে হল কথাটা বড্ড বেখাপ্পা হয়ে
গেল।
এইসব দাঙ্গা-ফাঙ্গা বা কোনো ধরনের ভায়োলেন্স যেন দেখতে পায়, বুঝেছ? রাজাকেও বলে দিয়ো।
অর্পিতা মাথা নেড়ে সাবধানে টিভি চালাল। ভলুম কমিয়ে দিল। অর্পিতার মাথায় আজকাল সারাক্ষণই
দাঙ্গা। টিভিতে এখন সাবানসুন্দরী নাচছে। প্রায় নিঃসাড় শরীরটাকে বাথরুমে টেনে নিয়ে যেতে যেতে
বিনয় বলল—পৃথিবীর সব জার্ম, ভাইরাস, ময়লা কীভাবে পরিষ্কার করা যায় বলো দেখি?
অর্পিতার ঘেমো মুখে জোড়া ভুরু ডানা মেলে জিজ্ঞাসায়।
—পারলে না তো? লাইফবয়।
পাখি ডানা গুটিয়ে মুহূর্তে স্বস্থানে। বিনয় বাথরুমের দরজা লাগিয়ে দিল। টিভিতে সাবানসুন্দরী গান
ধরেছে—তন্দরুস্তি কী রকসা করতা হ্যায় লাইফবয়।
ডিপার্টমেন্টের তালা খুলেও বিনয় ভিতরে ঢুকল না। আশপাশ খালি দেখে সিগারেট ধরাল। হঠাৎ
সামনে বিকাশ শর্মা। স্টুডেন্টস ইউনিয়নের প্রাক্তন জি এস। একসময় বিনয়ের খুব ভক্ত ছিল। গায়ে
ডোরাকাটা টাইট হাফশার্ট, বুক খোলা। টাইট মাসল। বুক দিয়ে, হাত দিয়ে, ভুরভুরে ডিওডোরেন্ট।
বিকাশ বলল—আমি প্রাক্তন ছাত্রবিলাকও শান্তি সমদলত যাম, প্রিন্সিপালে মাতিসে। বলেই বিকাশ
নিজের ভুল বুঝতে পেরে বাংলায় বলল—প্রিন্সিপালের রুমে গেছিলাম পেচ্ছাপ করতে। ছিঃ কী নোংরা!
বাঙালি বলে, কোথাও অসমিয়া। বিকাশ শব্দ করে থুতু ফেলল, রজনীগন্ধাচূর্ণসহ। টিচার্স-টয়লেটে
গিয়ে পেচ্ছাপ করে এসে বলল—চলুন স্যার, সময় হয়েছে।
বিকাশ চালাক-চতুর ছেলে। অনেক খবর রাখে। রাজনীতি করে। অনেক কানেকশন আছে। বিকাশকে
পেয়ে বিনয় অকূলে কূল পেল, কাঁধে আলতাে করে হাত রেখে বলল—আরে দাঁড়াও, যাব তো। তারপর খানিকটা সতর্কভাবে—আচ্ছা, কাটা-হাতের ঘটনাটা কী হল বলো তো?
—ও কিছু না।
বিকাশ মাছি তাড়াল।
—আমি দেখে এসেছি। লোকজনের কথাবার্তা শুনে মনে হল অশান্তি ছড়াতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।
বিকাশ রজনীগন্ধা আর তুলসী মেশাল হাতের তালুতে, মুখে পুরে বলল— আপনিও পারেন। ওইসব
দেখতে যাওয়ার কী দরকার? তারপর একপর্দা গলা নামিয়ে—দেখতেই তো পাচ্ছেন পরিস্থিতি। কখন
কী হয় ঠিক আছে?
বিনয় ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ধুকপুক টের পেল, অনেকক্ষণ বাদে আবার। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল—কিছু
শুনেছ নাকি বিকাশ? তোমরা তো অনেক কিছু জানো টানো।
বিকাশ হালকা একটা হাসি ঝুলিয়ে দিল ঠোঁটের কোণে—থানাভর্তি মানুষ দেখে এলাম। বোধহয় ওই
হাত নিয়েই ঝামেলা হচ্ছে। কার হাত কে জানে?
বিনয় প্রাণপণ টান দেয় সিগারেটে। ভয়ংকর কথাগুলো বিকাশ কী অবলীলায় বলে যাচ্ছে। কীভাবে
এত সহজ, স্বাভাবিক থাকে মানুষ, এত ভয়ডরহীন? বিকাশ হাঁটতে শুরু করল। বিনয় পেছন পেছন যেতে যেতে বলল—তুমি জালালকে চেন বিকাশ? লোকে বলাবলি করছিল হাতটা নাকি জালালের?
—মানুষও পারে কেলা…।
—ওদের চেন তুমি?
—ফালতু ছেলে। উগ্রপন্থী।
বিকাশের হাতটা ধরল, কবজির কাছে। ডুবন্ত মানুষের মতো মাথা তুলে নিঃশ্বাস নিতে চাইল।
—তাহলে বিকাশ? এখানেও যদি দাঙ্গা শুরু হয়? কী হবে তবে?
বিকাশ তার সবল হাত তুলে আশ্বস্ত করার ভঙ্গি করে বলল—আমাদের কোনো চিন্তা নেই স্যার।
আমরা তো এদিকেও নেই, ওদিকেও নেই। আমাদের সঙ্গে কারও ঝগড়া-বিবাদ নেই, ঠিক কি না?
বিকাশের বডি ল্যাংগুয়েজ, কণ্ঠস্বর শান্ত, সাবলীল। অতল তলের জল থেকে ভুস করে ভেসে উঠল
বিনয়। রুমাল বের করে ঘাড়, গলা, কপাল মুছল। বিকাশ লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেছে। এক কাপ চা এই মুহূর্তে না হলেই নয়। কিন্তু ক্যান্টিনে যেতে গেলে দুটো হার্ডল পেরোতে হবে। প্রিন্সিপালের
রুমের সামনে ছোট্ট মাঠে টিচার্স ইউনিটের সেক্রেটারি কমল হাজরিকা ছাত্র-ছাত্রীদের
শান্তিমিছিলের গুরুত্ব বোঝাচ্ছেন। কমলদা দারুণ বক্তা। কোনোমতে পাশ কেটে বেরোলেও দ্বিতীয়
হার্ডলে আটকে গেল বিনয়। ভাইস প্রিন্সিপালের রুমের বাইরে শিক্ষকদের জটলা। অনেকগুলো চোখ
একসঙ্গে তাকে বিদ্ধ করল। নিরুপায় হয়ে সে ভাইস প্রিন্সিপালের রুমে সেঁধিয়ে গেল। জুনিয়র একজন তাকে চেয়ার ছেড়ে দিল। ভাইস প্রিন্সিপাল তাকে দেখে বললেন—সব সরকারই দেখি লেট-এ চলে। বলে নিজেই হাসলেন হা হা করে।
বিনয় অনেকক্ষণ পর, আসলে অনেকদিন পর হাসল। এই পরিস্থিতিতে প্রাণ খুলে হাসাও তাে যায়
না। ভাইস প্রিন্সিপাল শইকিয়া জুনিয়রদের জ্ঞান দিচ্ছেন—গান্ধিজির অহিংসা নীতিকেই
আলটিমেটলি মেনে নিতে হবে আমাদের। অন্য কোনো পথ নেই।
সে।এহসান একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটে যাচ্ছে অস্থিরভাবে।বানেশ্বর আলপিন দিয়ে নখের ময়লা
পরিষ্কার করছে। কমলদা এসে ঢুকলেন হুড়মুড় করে, ভাইস প্রিন্সিপালকে বললেন—প্রিন্সিপাল স্যার
শান্তিমিছিল নিয়ে ধবলপুরের দিকে যেতে মানা করেছেন।
সোজা আই বি অবধি গিয়ে ঘুরে চলে আসাই ভালো। পথে থানা, সার্কল অফিস তো পেয়েই যাচ্ছি।
দু-চারজন সমর্থনে হাত তুলল। বেশির ভাগই জগন্নাথ। কোনদিকে বোঝা গেল না, বরাবরের মতো।
সদানন্দ দরজার মুখে দাঁড়িয়ে গলাসহ মুখটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল—আমার আপত্তি আছে। পুলিশ তো ধবলপুরে যেতে বাধা দিচ্ছে না। এইভাবে আমরা ধবলপুর সম্পর্কে অনর্থক আতঙ্ক ছড়াচ্ছি।
—ঠিক ঠিক। বাইরে তরুণকণ্ঠের কোরাসে সমর্থন।
. শালা জ্ঞান দিচ্ছে—বিনয় মনে মনে আওড়াল।
—শুধু জোশ দেখালেই হয় না, যে পরিস্থিতি, একটা কিছু যদি—মানে,বাইচান্স? হোঁচট খেতে খেতে
লাইন কমপ্লিট করলেন শইকিয়া।
—শান্তিমিছিলে পুলিশ ছাড়া কেউ গুলি করে না স্যার। বাইরে থেকে তির ধেয়ে এল।
নবীন-প্রবীণের ঠোকাঠুকি চলে হামেশা, যেকোনো ছুতোয়। বিনয় মাঝামাঝি, সারাজীবন যেমন। ভাইস
প্রিন্সিপালের ভোটে শেষপর্যন্ত প্রবীণদের জয় হল। বিনয় আবার হাসল নিঃশব্দে।
স্তূপাকৃতি চুন দাঁতের গোড়ায় ফেলে দিয়ে বললেন— আমার একটা প্রস্তাব আছে। মিছিলের ব্যানারটা
একদিকে ধরবে বানেশ্বর, আরেক দিকেএহসান। কেমন হবে? একটা মেসেজ দেয়া যাবে সোসাইটিকে।
আপনারা কী বলেন?
শ্মশানের নৈঃশব্দ্য নেমে এল চরাচরে। বিনয় কোথায় যেন একটা কাঁপুনি অনুভব করল। স্পষ্ট দেখতে
পেল সে, জোড়া জোড়া চোখে বিদ্ধ হতে হতে এহসানের চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। ম্যাগাজিনের পাতা
মুচড়ে দিচ্ছে এহসানের ক্ষিপ্ত আঙুল। বানেশ্বর মাথা নিচু, যেন হাজার বছরের প্রাচীন মূর্তি
টুরিস্টের ক্যামেরার মুখোমুখি। মানুষ-মানুষীর নিঃশ্বাস-ধ্বনি ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠতে শুরু করলে
বিনয় বাইরে বেরিয়ে এল। শইকিয়া নির্ভুলভাবেই দুই পরস্পর শত্রুকে যেন চিনিয়ে দিলেন। এখন থেকে কি বানেশ্বর আর এহসান বাঁশি, নাচ, জউ, সর্ষেফুল ভুলে গিয়ে শুধু গোপন অস্ত্রে শান দিয়ে যাবে? অথচ এই তো সেদিনও, দিগন্ত জোড়া ছিল হলুদ সর্ষেফুল। এত হলুদ যে, রাতেও, চার গ্লাস জউ
খাওয়ার পরেও হলুদই ছিল পুরোপুরি। হিরা দু-গ্লাসের বেশি কখনও খায় না, কিন্তু সেদিন আকাশ-
বাতাস, নদীর ঘ্রাণ, এমনকী এহসান-বিনয় বানেশ্বরের গল্প—সবকিছু ছিল অন্যরকম। বিনয় তিন
নম্বর গ্লাস শেষ করে চার নম্বরটা ধরে তিতলির কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, গ্লাসের
তরল চলকে পড়েছিল পাঞ্জাবিতে—তখন হিরারও হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কান্না। এহসান উদাস,
নিষ্পলক চাঁদ দেখছিল। বানেশ্বর বরাবরের মতো ভাবলেশহীন, চোখের পাতা ধীরে ধীরে নেমে আসছিল তার। ওই পরিবেশে বাধ্য হয়ে হিরা আরও দুই গ্লাস জউ খেয়ে ফেলেছিল। তারপর তারা আর কতটা খেয়েছিল অথবা আদৌ খেয়েছিল কি না বিনয়ের অতশত মনে নেই। শুধু মনে আছে—সে হলুদ সর্ষেফুলের ছোঁয়া নিচ্ছিল আঙুলের ডগায়, হালকা মিষ্টি গন্ধ টেনে নিচ্ছিল বুকে, ঠিক তখনই বানেশ্বর ধরেছিল বাঁশি। এহসানের হাতে তখনও মদের গ্লাস, বাঁশির অচেনা সুরে একটু একটু মাথা দোলাচ্ছিল, তারপর শরীর। বাঁশির সুর সর্ষে ফুলগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অদৃশ্য নদী, বাঁশঝাড় আর এহসানের দিকে। তারপর সবাইকে হতভম্ভ করে দিয়ে এহসান হঠাৎই বাঁশির সুরে নাচতে শুরু করে দিয়েছিল। নাচতে নাচতে এহসান চলে গিয়েছিল সর্ষেফুলের ভেতরে—আরও ভেতরে। সে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
শান্তিমিছিল এগিয়ে যাচ্ছে। সমান্তরাল দুটো লাইন চলছে। এহসান তার লাইনেই। দু-চারজনকে
টপকাতে পারলেই তার কাছে পৌঁছোনো যাবে। বিনয় করলও ঠিক তা-ই। করেই বুঝল, সে সবার নজরে পড়ে গেছে। বিনয় নিচু গলায় বলল- কাটা হাতের কীহল? এহসান ঠোঁট ওলটাল না -জানার ভঙ্গিতে।
ফোন করেনি, বিনয় নিশ্চিত। বিনয় চুপ করে রইল।এবার ফোনের ওপারে অর্পিতার কান্নাভেজা
কণ্ঠ—আমি নিউজ দেখছিলাম। টিভিতে আগুন দেখে তিতলি ভায়োলেন্ট হয়ে গেছিল। কিছুতেই আজকে কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না। ভয় পেয়ে আমি গুয়াহাটিতে ভাইকে ফোন করেছি। ভাই বলল ইমিডিয়েট গুয়াহাটিতে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে। ভাই মানে বিনয়ের ছোটো ভাই বিভোর, অর্পিতার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। যা বলে—বেদবাক্য। অর্পিতা কাঁদছে। বিনয় অসহায় বোধ করল।বুঝে উঠতে পারছে না তার এখন কী বলা উচিত। কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করে অর্পিতা ফোন কেটে দিল।
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফোনে গার্জেনদের জানাতে হচ্ছে। চাপা ক্ষোভে ফেটে পড়ল বিনয়—
বাচ্চাদের তোমরা এসবের মধ্যে জড়াচ্ছ কেন?
—এসবের মধ্যে মানে?
—এইসব মিছিল-ফিছিল।
বিনয় ভনিতায় না গিয়ে এবার সরাসরি বলল—ধবলপুরের দিকে যাচ্ছ না তো?
— যাচ্ছিই তো! অবাক হওয়ার সুর কৌশিকের গলায়—তবে ধবলপুর সেন্টার অবধি যাচ্ছি না।
— ইমপসিবল। হবে না।
চাপা আতঙ্ক এবার লাভা উদগিরণ করল—আমার ছেলে যাবে না। তোমরা জান না পরিস্থিতি কেমন?
—এই পরিস্থিতি তো বদলাতে হবে স্যার। কৌশিক এখনও বরফ-শান্ত।
—না স্যরি। রাজা যাবে না।
বিনয় মোবাইলের সুইচ অফ করে দিল তীব্র হিংস্রতায়। মুখ মেলে হাঁপাল কিছুক্ষণ। একটু ধাতস্থ
হতেই মনে হল কৌশিকের সঙ্গে অকারণে রূঢ় ব্যবহার করে ফেলেছে। ভেবে দেখলে এত আতঙ্কিত
হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাড়ি ফিরে ফোন করে কৌশিককে স্যরি বলতে হবে। বিনয় ভারী পা দুটো
টেনে নিয়ে চলল। মিছিল অনেকদূর এগিয়ে গেছে। রাস্তার পাশেই থানা ক্রস করল। বিনয় বিকাশকে
খুঁজতে লাগল। তাকেই একমাত্র ভরসাস্থল বলে মনে হল।
ধরবে বলে দৌড় লাগাল। উটপাখির মতো দৌড়ে যাচ্ছে বিনয়। শান্তিমিছিলে সে মুখ গুঁজে দিতে চায় ঠিক উটপাখির মতো। ভিড়ে তাকে কেউ আইডেন্টিফাই করতে পারবে না। অর্পিতা, রাজা, তিতলি সবাই সুরক্ষিত থাকবে—মাথা গুঁজে —সংসারে, ভিড়ে, উদাসীনতায়। তারা কোন পক্ষে জানতে চাইবে না কেউ কোনোদিন।
দোকানের আড়াল নিল কিছুক্ষণের জন্য। মিছিল অদৃশ্য হতেই বিনয় সলজ্জ হাসল,বলল—বিকাশ, পান খাবে?
—খাওয়াবেন? চলুন খাই।
পান চিবোতে চিবোতে বিকাশ বলল—আপনারা না স্যার বড্ড ভীতু। অত ভয় পেলে চলে? আমাদের
কেউ তো টার্গেট করছে না। তবে একটু সাবধানে থাকতে হবে এই যা।
সাংবাদিক-বন্ধু একটু আগে ফোন করে জানাল, সব রাজনৈতিক দল আর ছাত্রসংগঠন নিয়ে এসডিসি
মিটিং করেছেন। সব দলই নাকি বলেছে নয়ানজুলিতে দাঙ্গার আগুন ছড়াতে দেবে না, যেকোনো মূল্যে দাঙ্গা রোধ করবে। কাল বোধহয় তেজপুরে ডিসির সঙ্গে মিটিং। ধবলপুর একটু সেনসিটিভ জায়গা তো।
বিনয়ের বুকের ওপর থেকে বড়ো একটা পাথর সরে গেল মুহুর্তেই। যেন অনেকক্ষণ পর সে প্রাণ
খুলে শ্বাস নিতে পারল। বাইরে তেজালো রোদ। কিন্তু হঠাৎ ফুরফুরে একটা হাওয়া তাকে ছুঁয়ে গেল।
বিনয় এখন অনেক হালকা অনুভব করছে, যেন সে উড়ে যেতে পারে পেঁজা তুলো হয়ে। বিকাশ আরও কী সব যেন বলে যাচ্ছে। সেইসব কথার কিছুই তার কানে এখন ঢুকছে না। বিকাশকে তার যেন বিশাল এক জাদুকর মনে হল। সে চাইলে এখনই আকাশ ফুঁড়ে নেমে আসবে মায়াময় বৃষ্টি। 'একদিন আপনার বাড়িতে আড্ডা দিতে যাব ' বলে বিকাশ চলে গেলে বিনয় মনে মনে একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে পরিচিত দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। রাজার জন্য ভিডিয়ো গেমের সিডি, তিতলির জন্য খেলনা আর অর্পিতার জন্য কোল্ড ড্রিংকস কিনল।
বিনয় বিকাশের যাবতীয় অভয়বাণী ইকো করল—চিন্তা নেই, আমাদের কিছু হবে না। কারণ আমরা
কোনো পক্ষে নেই।
—গাড়ি থেকে নামিয়ে মা-বাবার সামনে খুন করেছে ছেলেকে।
—আমাদের ভয় নেই।
—শরণার্থী শিবিরে হাজার হাজার মানুষ।
—আমরা সেফ।
—কাল কোনো একটা দল অসম বনধ ডেকেছে।
—একদিন ছুটি পাওয়া যাবে।
—পরশুও নাকি বনধ হতে পারে।
—আরও একদিন বন্ধ, মন্দ কী। আমাদের কোনো ভয় নেই অর্পিতা।
শান্তিমিছিলে যেতে পারেনি বলে স্কুল থেকে ফেরার পর থেকেই রাজা রাগে গুম মেরে ছিল। ভিডিয়ো
গেম পেয়ে রাগ ফুড়ুৎ। অনেক শত্রু মেরে, শত্রুশিবির বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিয়ে রাজা ঘুমোতে গেল।
বিনয় আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেল। একটা চিৎকার গলা ভেদ করে উঠে আসতে চাইল, কিন্তু
আটকে গেল কোথাও। হলুদ সর্ষেখেত তছনছ করে চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে দু-হাত কাটা মানুষের দল। তাদের নিশ্চিন্ত প্রশান্ত মুখ। খেতের এক কোণে কাটা-হাতের বিশাল পিরামিড। লোকগুলো এসে পিরামিড ভাঙতে লাগল পা দিয়ে। কাটা-হাত চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। লোকগুলো এবার পা দিয়ে নিজের নিজের হাত খুঁজতে লাগল। অযুত-নিযুত হাতের তলায় ধীরে ধীরে
দোলাতে লাগল,আকাশমুখী, স্বতন্ত্র হাত নাড়তে লাগল। একটা হাত তুলতুলে নরম, তালুর মাঝামাঝি
দীর্ঘ প্রত্যয়ী রেখা। অন্যটি সবল, বেঁটে বেঁটে আঙুল, কবজিতে কাটা দাগ।সবল মূর্তি কবন্ধগুলোর
কাছে গিয়ে বলল— তুমরার তো একটাও হাত নেই। এইবার দেখি, হাত মার কী কইরা।
—হা হা, হো হো, হিহি।
লোকগুলো ধাতবহাসিতে ফেটে পড়ল। অমনি চরাচর ছেয়ে ফেলল ধূসরকালো ধোঁয়া। ধোঁয়ার সঙ্গে
ছাই। ছাইয়ের সঙ্গে পোড়া-মাংসের গন্ধ। সবাই সশব্দে নাক টেনে গন্ধ নিল। কেউ একজন চিৎকার
করে উঠল—শান্তিমিছিল বের করতে হবে।
—হয়, হয়। শান্তি সমদল উলিয়াব লাগিব। এতিয়াই, এতিয়াই।
—হ্যাঁ, এখনই, এখনই।
দু-হাত কাটা মানুষের মিছিল কাটা-হাত মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে লাগল—ধোঁয়া, ছাই আর পোড়া গন্ধের
লক্ষ্যে।
*********************************************************************************
১. নাম – কান্তারভূষণ নন্দী।
২. জন্ম – নগাঁও, অসম।
৩. বাস করেন – ঢেকিয়াজুলি, অসম।
৪. জন্ম সাল – ১৯৭০
৫. পড়াশোনা – স্নাতকোত্তর
৬. পেশা – অধ্যাপনা
৭. লেখালিখি – ৯-এর দশকের শুরু থেকে।
৮. প্রকাশিত গ্রন্ত – কয়েকটি মৃত্যুর অসম্পূর্ণ বিবরণ (গল্পগ্রন্থ) যাপনকথা
১০. যোগাযোগ – মোবাইল – ইমেল –
আসামের নিজস্ব এক সংকট-কথা। দারুণ গল্প!
মনে আছে সময়টার কথা। ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলাম অনেক শিবিরে। জীবন্ত বর্ণনা, বর্ণনায় জাদু বাস্তবের প্রয়োগ, অসামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা…সব মিলিয়ে এক বিপন্ন সময়ের দলিল। লেখককে সাধুবাদ।