মার্গারেট মিচেলের ধারাবাহিক উপন্যাস : যেদিন গেছে ভেসে
যুদ্ধ শুরু হবার পর এই প্রথম অ্যাটলান্টার মানুষ যুদ্ধের দামামা ঘরের কাছে শুনতে পেল। ভোরবেলা যখন শহরের কোলাহল তখনও শুরু হয়নি, দূরে কেনিসো পাহাড় থেকে কামানের গোলার মৃদু আওয়াজ ভেসে আসত – গ্রীষ্মের দিনের মেঘের মৃদুমন্দ গুরুগুরু আওয়াজের মত। কখনো কখনো আওয়াজটা এত জোরে হত যে দুপুরের যানবাহনের চলার শব্দকে ছাপিয়েও শোনা যেত। লোকেরা শুনেও না শোনার ভান করত। স্বাভাবিক কথাবার্তা চালিয়ে যেত, হাসত, যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করত – যেন এইভাবেই বাইশ মাইল দূরে থাকা ইয়াঙ্কিদের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করা যাবে। কিন্তু তবুও উদগ্রীব হয়ে সেই আওয়াজ আসছে কিনা শোনার চেষ্টা করত। সারা শহর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল – যতটা না নিজের নিজের কাজ নিয়ে, তার চেয়েও বেশি এই আওয়াজ শোনার জন্য। দিনের মধ্যে হাজার বার ওদের বুক দুরদুর করে ওঠে। নিজেদের মধ্যে জল্পনা চলতে থাকে – আওয়াজটা কি আজ আরও একটু জোরে শোনাচ্ছে? না কি মনের ভুল? জেনারাল জনস্টন কি ওদের আটকে রাখতে পারবেন? এবারও?
ওপরে বুঝতে না দিলেও একটা আতঙ্ক সবার ভেতরে ভেতরেই ঘোরাফেরা করছিল। পিছিয়ে আসা শুরু হওয়ার পর থেকেই স্নায়ুর ওপর যে চাপ তৈরি হচ্ছিল, সেটা এখন সহনসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। ভয় পাবার কথা কারও মুখে নেই – যেন ভয় একটা নিষিদ্ধ ব্যাপার। তার বদলে সবাই জেনারালের কড়া সমালোচনা করে দুশ্চিন্তার হাত থেকে রেহাই পেতে চাইত। মানুষ প্রবল উত্তেজনায় ভুগছে। শেরম্যান একেবারে দোরগোড়ায় এসে পৌঁছে গেছেন। আর একটা পশ্চাদাপসরণ মানেই কনফেডারেটদের শহরের মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে।
এমন একজন জেনারাল দরকার যিনি পিছিয়ে আসবেন না! যিনি এক জায়গায় স্থিতু হয়ে লড়াই চালিয়ে যাবেন!
কামানের আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই, স্থানীয় সেনাবাহিনী – যাদের “জো ব্রাউনের পোষা দল” বলে অভিহিত করা হত, আর হোমগার্ডের দল – সবাই অ্যাটলান্টা ছেড়ে চলে গিয়ে জনস্টনের পেছন থেকে চ্যাটাহুচি নদীর ওপরের সেতু আর নৌকা রক্ষা করার চেষ্টা করছে। সেদিনটা ছিল বেশ মেঘলা মুখভার করা দিন। ওরা যখন ফাইভ পয়েন্ট ধরে কুচকাওয়াজ করে মারিয়ট রোড ছেড়ে এগিয়ে চলছিল, তখন ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। সমস্ত শহর ওদের বিদায় জানাবার জন্য ভেঙ্গে পড়েছিল। সবাই পীচট্রী স্ট্রীটের দোকানের কাঠের শেডের তলায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে হর্ষধ্বনি করছিল।
স্কারলেট আর মেবেল মেরিওয়েদার পিকার্ডকে সৈন্যদের বিদায় জানানোর জন্য হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল। কারণ আঙ্কল হেনরি হ্যামিল্টন আর গ্র্যাণ্ডপা মেরিওয়েদার – এঁরা দুজনও হোমগার্ড ছিলেন। ওরা দুজনেই মিসেজ় মীডের সাথে, ভিড়ের মধ্যে এদিক ওদিক করে, দেখার জন্য ভাল একটা জায়গা খুঁজছিল। সব দক্ষিণের লোকের মতই স্কারলেটও সব কিছুকেই আশার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাববার চেষ্টা করত, কিন্তু নানা বয়সের, নানা ধরণের সৈন্যের সমাবেশ দেখে ওর মধ্যে একটু ভয় ভয় করছিল। ব্যাপারটা এতই গুরুতর যে বাচ্চা আর বুড়ো সবাইকেই আজ যুদ্ধে চলে যেতে হচ্ছে! দলের মধ্যে শক্তসামর্থ্য তরুণ লোক খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগল – যারা মাথায় পালকের টুপি পরে, উজ্জ্বল ইউনিফর্মে হই হই করে যুদ্ধে যাচ্ছে। কিন্তু বৃদ্ধ এবং নাবালকদের সংখ্যা দলের মধ্যে এতই বেশি, যে ও ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। এই দলে ওর বাপীর থেকেও বয়স্ক লোকেরা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যে সাবলীল ভঙ্গীতে ড্রাম আর বিউগলের তালে তালে হেঁটে যাবার চেষ্টা করছেন। গ্র্যাণ্ডপা মেরিওয়েদার – যিনি বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচবার জন্য মিসেজ় মেরিওয়েদারের সব থেকে ভাল শালটা মাথায় দিয়ে রেখেছেন – মেয়েদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে স্যালিউট করলেন। উনি প্রথম দলটার সঙ্গেই ছিলেন। ওরা রুমাল নেড়ে ওঁকে বিদায় জানাল। মেবেল স্কারলেটের কাঁধ আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “আহা, বেচারা! যদি একটু জোরে বৃষ্টি আসে তাহলে উনি কি করবেন! আর ওর বাতের ব্যাথাটা ____”
আঙ্কল হেনরি হ্যামিল্টন গ্র্যাণ্ডপা মেরিওয়েদারের পেছনের সারিতেই কুচকাওয়াজ করে চলছিলেন। কালো কোটের কলার তুলে কান ঢেকে রেখেছিলেন। বেল্টের দুদিকে দুটো মেক্সিকান পিস্তল ঝুলছিল। হাতে একটা কার্পেটের থলি নিয়ে এগিয়ে চলছিলেন। তাঁর পাশে পাশে ওঁর কৃষ্ণকায় ভ্যালে পা মিলিয়ে চলছিল। তার বয়সও আঙ্কল হেনরির থেকে কম হবে না। একটা ছাতা খুলে দুজনের মাথার ওপরে ধরে রেখে বৃষ্টির হাত থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল। এই বৃদ্ধদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছিল কিশোরবাহিনী – যাদের কারও বয়স ষোলো বছরের বেশি হবে না। অনেকেই স্কুল পালিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে এসেছে। ওদের পরনে মিলিটারির ক্যাডেট ইউনিফর্ম- মাথায় পালকের টুপি। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। ফিল মীডও এই দলে। খুব গর্বের সঙ্গে সদ্যমৃত দাদার ছোরা আর পিস্তল নিয়ে এগিয়ে চলেছে। মাথার টুপি একপাশে হেলিয়ে। যতক্ষণ পারলেন, মিসেজ় মীড ওকে হেসে আর হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। তারপর এক মুহুর্তের জন্য স্কারলেটের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন, যেন সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
অনেকেই সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। কনফেডারেসির কাছে না ছিল রাইফেল না অন্য কোন অস্ত্রশস্ত্র। পরাজিত ইয়াঙ্কিদের অস্ত্রশস্ত্র এরা দখল করবেন, এরকম একটা আশা নিয়ে এঁরা যাচ্ছেন। অনেকে বুটজুতোর মধ্যে ছোট ছোট ছুরি গুঁজে নিয়েছিলেন। কারো কারো হাতে বর্শার মত একটা অস্ত্র রয়েছে যেটাকে “জো ব্রাউনের বর্শা” বলা হত। যাঁরা একটু ভাগ্যবান, তাঁরা কাঁধে একটা করে গাদাবন্দুক ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন আর বেল্টের মধ্যে বারুদের কৌটো।
কামান বাহিনী যখন ভিড়ের মধ্যে কাদা ছিটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন স্কারলেটের নজরে পড়ল খচ্চরের পিঠে বসা একজন কৃষ্ণকায় মানুষের দিকে। লোকটা একটা কামানের পাশে পাশেই চলছে। মুখচোখ গম্ভীর। ওকে দেখেই স্কারলেট চেঁচিয়ে উঠল, “আরে ও যে মোজ়! অ্যাশলের মোজ়! কিন্তু ও এখানে কি করছে?” ও ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে বলল, “এই যে মোজ়, একটু থামো!”
ছেলেটা ওকে দেখে হেসে লাগাম টেনে ধরে খচ্চরটা থামাল। তারপর নামবার উপক্রম করতেই পেছন থেকে একজন সার্জেন্ট হুকুম দিল, “খচ্চর থেকে নেমো না! তাহলে ভাল হবে না! আমি তাহলে তোমার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেব! আমাদের তাড়াতাড়ি পাহাড়ে পৌঁছাতে হবে।”
অনিশ্চিতভাবে মোজ় একবার সার্জেন্টের দিকে আর একবার স্কারলেটের দিকে তাকাতে লাগল। স্কারলেট কাদার মধ্যে দিয়ে চলন্ত গাড়ির চাকা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে এসে মোজ়ের লাগামটা ধরল।
“এক মিনিট সার্জেন্ট! ঠিক আছে তোমাকে নামতে হবে না। কিন্তু এখানে তুমি কি করছ?”
“আবার যুদ্ধে যাচ্ছি, মিস স্কারলেট। এবারে মিস্টার অ্যাশলের বদলে বৃদ্ধ মিস্টার জনের সঙ্গে।”
“মিস্টার উইলক্সের সঙ্গে?” কিন্তু তাঁর তো সত্তর বছর বয়স হয়ে গেল, স্কারলেট অবাক হয়ে ভাবল। “উনি কোথায়?”
“ঐ যে শেষ কামানের সঙ্গে। ওখানে।”
“দুঃখিত ম্যাডাম। এই ছোকরা তুমি এগিয়ে চল।”
গোড়ালি পর্যন্ত ডোবা কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে স্কারলেট এক মুহুর্ত ভাবল। এটা কিছুতেই হতে পারে না! উনি এত বৃদ্ধ! আর অ্যাশলের মত উনিও মোটেই যুদ্ধটুদ্ধ ভালবাসেন না! একটু পিছিয়ে গিয়ে ও সকলের মুখগুলো দেখতে লাগল। একেবারে পেছনের কামানটা যখন গড়াতে গড়াতে এল, তখন দেখতে পেল উনি আসছেন, ঋজু, লম্বা, মাথা ভর্তি শুভ্রকেশ, স্ট্রবেরি রঙের ঘোড়ায় চড়ে আসছেন। গায়ে সাটিনের কাপড় পরানো। আরে ওটা তো নেলি! মিসেজ় বিয়াট্রিস টার্লটনের প্রিয়তম ঘোড়া!
স্কারলেটকে কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিস্টার উইল্কস একটু হেসে ঘোড়া থেকে নামলেন। “আমি আশা করেছিলাম তোমার সঙ্গে দেখা হবে। তোমার বাড়ির লোকেরা তোমার জন্য অনেক খবর দিয়েছেন। কিন্তু বলবার সময় নেই এখন। আজ সকালে আমাদের বের করে এনে কেমন তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে, সে তো দেখতেই পাচ্ছ।”
“ওহ মিস্টার উইল্কস,” অসহায় ভাবে বলে উঠল স্কারলেট। “যাবেন না। আপনাকে কেন যেতে হবে বলুন তো?”
“তাহলে তুমিও ভাবছ আমি বুড়ো হয়ে গেছি, তাই না?” হেসে বললেন। হাসিটা একেবারে অ্যাশলের মত, শুধু মুখে বয়সের ছাপ। হয়ত কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যাবার জন্য আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। কিন্তু ঘোড়ায় চড়া আর গুলি চালানোতে নয়। আর মিসেজ় টার্লটন দয়া করে আমাকে নেলিকে নিয়ে যেতে দিয়েছেন। তাই একটা ভাল ঘোড়ার পিঠে চেপে যাবার সুযোগ পেয়েছি। আশা করব যেন নেলিকে ভাল মত ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি। নইলে মিসেজ় টার্লটনকে মুখ দেখাতে পারব না। এটাই ওঁর শেষ সম্বল।” তারপর হেসে বললেন, “তোমার মা, বাবা আর বোনেরা ভাল আছেন। ওঁরা তোমাকে ভালবাসা জানিয়েছেন। আর একটু হলে তোমার বাবা তো আমাদের সাথে চলেই আসছিলেন।”
“না না, বাপী নয়! বাপী নয়!” স্কারলেট ভয়ে কেঁপে উঠল। “উনি নিশ্চয়ই যুদ্ধে যাচ্ছেন না?”
“না। যাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হাঁটুর বাতের জন্য ভাল করে হাটতেই যে পারেন না। তাও আমাদের সঙ্গে চলে আসছিলেন। তোমার মা বলেছিলেন যদি উনি ঘোড়ায় চড়ে মাঠের বেড়া ডিঙিয়ে যেতে পারেন, তাহলে ওঁর কোন আপত্তি নেই, কারণ যুদ্ধে অনেকে কঠোর অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। তোমার বাবা মনে করলেন সেটা তো খুবই সোজা। কিন্তু ঘোড়া বেড়ার কাছে পৌঁছেই হঠাৎ থেমে গেল। তুমি বিশ্বাস করবে কি তোমার বাপী পড়ে গেলেন।খুব ভাগ্য ভাল যে ওঁর ঘাড় ভেঙ্গে যায়নি। উনি কিরকম জেদী সে তো তুমি জানোই। এর আগেও উনি তিনবার চেষ্টা করেছেন। শেষে মিসেজ় ও’হারা আর পোর্ক মিলে ওঁকে ধরে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। ব্যাপারটা উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। বলেন, তোমার মা নাকি ঘোড়াটার কানে কানে গোপন কিছু বলে দিয়েছিলেন। উনি আর সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করার অবস্থায় নেই। তোমার লজ্জা পাওয়ার দরকার নেই স্কারলেট। কাউকে না কাউকে তো বাড়িতে থাকতেই হবে। না হলে সেনাবাহিনীর জন্য শস্য উৎপাদন করবে কে?”
লজ্জা নয়, স্কারলেট মনে মনে কিছুটা নিশ্চিন্তই হল।
“ইণ্ডিয়া আর হানিকে আমি মেকনে পাঠিয়ে দিয়েছি, ওরা বারদের সঙ্গে থাকবে … আর মিস্টার ও’হারা টারার সঙ্গে টুয়েল্ভ ওকসেরও দেখাশোনা করবেন। নাঃ আর দেরি করা যাবে না। এসো, তোমার কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বিদায় নিই।।”
“ও ভালই আছে।”
অ্যাটলান্টা অতিথি আর ভিটেমাটি ছেড়ে আসা মানুষে ভরে গেল। লড়াইতে জখম সৈনিকদের স্ত্রী আর মায়েরাও অ্যাটলান্টায় চলে এলেন প্রিয়জনদের পাশে থাকার জন্য। দলে দলে কমবয়সী সুন্দরী মেয়েরাও নিজেদের জেলা ছেড়ে এখানে এসে এখানে ভিড় করল। ওদের জেলায় বিবাহযোগ্য পুরুষমানুষ কেউ বেঁচে ছিল না। আন্ট পিটির এই ব্যাপারটাতে ঘোরতর আপত্তি ছিল। ওঁর মনে হত, এদের উদ্দেশ্য যেন ‘যেন তেন প্রকারেণ’ হবু বর পাকড়াও করা। ওরা যে কতটা বেশরম, এই ভাবনাটাই ওঁকে অবাক করে দিত! স্কারলেটও এদের মোটেই পছন্দ করত না! এই সব ষোড়শবর্ষীয়াদের পোশাক অন্তত দুবার নতুন করে সেলাই করা হয়েছে, চটিতে বেশ কিছু তাপ্পি লাগানো! ও এদের পাত্তা না দেবার চেষ্টাই করত। রেট বাটলার, তাঁর সর্বশেষ অভিযানের পর, যেসব কাপড় এনে দিয়েছিলেন, সেগুলো থাকায়, সবার চাইতে ওর পোশাকপরিচ্ছদ অনেক বেশি নতুন দেখাত। তা হলে কি হবে! ওর বয়স এখন উনিশ – আর এই সব বুদ্ধু ছেলেগুলোর নজর এই কমবয়সী বোকা বোকা মেয়েগুলোর দিকেই।
একে বিধবা, তার ওপর আবার এক সন্তানের মা –পরিস্থিতি একটু অসুবিধেজনক সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন কি এই সব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসৎ আছে? । দিনের বেলা হাসপাতাল আর রাত্রে নাচের আসর – এই নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে ওয়েডের দিকে নজর দেবার সময়ই নেই। ওর যে একটা বাচ্চা আছে সে কথাটাও মাঝে মাঝেই ভুলে মেরে দিত!
সৈনিকরা ছিল শহরের রক্ষাকর্তা। গ্রীষ্মের এই আর্দ্র রাতগুলোতে অ্যাটলান্টার প্রত্যেক ঘরে এদের জন্য দ্বার অবারিত থাকত। ওয়াশিংটন স্ট্রীট থেকে পীচট্রী স্ট্রীট পর্যন্ত সমস্ত বড় বড় বাড়ি আলো ঝলমলে হয়ে থাকত। রাইফল পিট থেকে ধুলোকাদা মেখে যে সব সৈন্যরা আসত, তাদের মনোরঞ্জন করা হত। রাতের আকাশে ব্যাঞ্জো, বেহালার মধুর আওয়াজ, নৃত্যরত পায়ের শব্দ আর হাল্কা হাসি ভেসে আসত। দলে দলে পিয়ানোয় বসে গলা মিলিয়ে বিষাদের গান গাইত “তোমার চিঠি পেয়েছিলাম, কিন্তু অনেক দেরিতে” আর যে সব মেয়েরা হাসিতে গানে ওদের ভরিয়ে রাখত তাদের দিকে তাকিয়ে চোখের ভাষায় যেন বলতে চাইত কি দরকার দেরি হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার! মেয়েরাও মোটেই অপেক্ষা করার পক্ষপাতি ছিল না একদম অপারগ না হলে। আনন্দের জোয়ারে আর উত্তেজনায় ভাসতে থাকা শহরে সবাই একেবারে বিয়ে করবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। জনস্টন তখন ব্যস্ত ছিলেন কেনিসো পর্বতে শত্রুপক্ষকে ঠেকিয়ে রাখতে। একসাথে অনেকগুলো বিয়েই তাড়াহুড়ো করে হয়ে গেল। মেয়েরা বান্ধবীদের বিয়ের পোশাক ধার করে পরল। ছেলেরা ভাঙা হাঁটুর পাশে তলওয়ার ঝোলাল। সে কি উত্তেজনা! কত খাওয়াদাওয়া! আর উল্লাস – হুররে! জনস্টন ইয়াঙ্কিদের বাইশ মাইল দূরে পাহাড়ে আটকে রেখে দিয়েছেন!
অতর্কিতে পেছন থেকে আক্রমণ হতে পারে এই আশঙ্কায় যে উচ্চতা থেকে জনস্টন এতদিন প্রতিরোধ বজায় রাখতে পেরেছিলেন, সেখান থেকে নেমে আসতে বাধ্য হলেন। এতদিন লড়াইতে তাঁর বাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা গেছিল। যারা বেঁচে ছিল, তারা ক্লান্ত পদক্ষেপে, বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে চ্যাটাহুচি নদীর দিকে নেমে এল। নতুন লোক পাওয়ার কোন আশাই নেই। এদিকে ইয়াঙ্কিরা টেনেসি থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত রেলপথ দখল করে নিয়েছিল। প্রতিদিনই নতুন নতুন লোক ওদের বাহিনীতে এসে যোগ দিচ্ছিল। মালপত্রের যোগান নিয়েও নেই কোনও সমস্যা। ধূসরবাহিনীকে কর্দমাক্ত পথ ধরে ক্রমাগত অ্যাটলান্টার দিকে পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।
লড়াই কর আর পিছিয়ে এসো! লড়াই কর আর পিছিয়ে এসো! ফলে ইয়াঙ্কিরা শহরের একেবারে কাছে চলে এল!। পীচট্রী খাঁড়ি আর মাত্র পাঁচ মাইল দূরে! কি করতে চাইছেন জেনারাল?
“আমাদের এমন একজন মানুষ দাও যিনি দাঁড়িয়ে থেকে লড়াই চালিয়ে যেতে পারবেন!” শহরের এই আর্তনাদ রিচমণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে গেল। রিচমণ্ড জানত যে অ্যাটলান্টার পতন হওয়া মানে যুদ্ধে হার অনিবার্য। চ্যাটাহুচি নদী পেরিয়ে আসার পরে, জেনারাল জনস্টনকে পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে জেনেরাল হুডকে দায়িত্ব দয়া হল। উনি এতদিন জনস্টনেরই তত্ত্বাবধানে একটা কোর-এর পরিচালনা করছিলেন। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শহর! হুড মোটেই পিছিয়ে আসার পাত্র নয়। কেনটাকির মানুষ। লম্বা, প্রবহমান দাড়ি আর উজ্জ্বল চোখ! বুলডগের মত জেদ বলে খ্যাতি আছে। উনি ঠিক ইয়াঙ্কিদের নদীর ওপারে ভাগিয়ে দেবেন! হ্যা ভাগিয়ে একেবারে ডাল্টনে নিয়ে ফেলবেন! সেনাবাহিনী কিন্তু তারস্বরে দাবী করতে থাকল, “বুড়ো জোকে আমাদের ফিরিয়ে দাও!” ওরা সেই ডাল্টন থেকে ওঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। তাই ওরা জানে – যা সাধারণ লোকের জানার কথা নয় – কিরকম প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে ওদের চলতে হয়েছে!
তারপর জুলাই মাসের প্রচণ্ড এক গরমের দুপুরে অ্যাটলান্টার ইচ্ছে পূরণ হল। জেনারাল হুড শুধু দাঁড়িয়ে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করলেন। পীচট্রী খাঁড়িতে তিনি সরাসরি ইয়াঙ্কি বাহিনীর মোকাবেলা করলেন। ওঁর বাহিনী রাইফেল পিট ছেড়ে সংখ্যায় দ্বিগুণেরও বেশি ইয়াঙ্কি বাহিনীর সৈন্যদের ওপর চড়াও হল।
সবাই প্রার্থনা করল হুডের বাহিনীর আক্রমণে ভয় পেয়ে ইয়াঙ্কি সেনারা যেন পালিয়ে যায়। শুরু হল কামানের গর্জন আর রাইফেলের গুলির আওয়াজ। পাশের পাড়া থেকেই যেন সেই আওয়াজ ভেসে আসছে। ঘন ঘন তোপের আওয়াজ। কালো ধোঁয়া গাছের ওপর দিয়ে মেঘের মত ঝুলে রয়েছে। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি কিছুই বোঝা গেল না।
***
প্রথম খবর পাওয়া গেল সন্ধ্যে নাগাদ। তাতে অনিশ্চয়তাই বেশি, পরস্পরবিরোধীও, এবং উদ্বেগজনক। সকালে যুদ্ধে যারা জখম হয়েছিল, খবরগুলো তারাই বয়ে আনল। কেউ কেউ দল বেঁধে এল, কেউ বা একা একাই। কোনও রকমে ধুঁকতে ধুঁকতে এসে পৌঁছল। যাদের চোট কম তারা গুরুতর ভাবে জখম লোকগুলোকে ধরে ধরে নিয়ে এল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্রোতের মত এসে হাসপাতাল ভর্তি করে ফেলল। বারুদের কালিতে সবার মুখ, চোখ আর শরীর নিগ্রোদের থেকেও বেশি কালো। ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সারা গায়ে মাছি ভন ভন করছে।
উত্তরদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সব আহত সৈন্যরা কোনক্রমে এসে প্রথমে আন্ট পিটি এবং অন্যান্যদের গেটের সামনে এসে সবুজ লনের ওপর লুটিয়ে পড়ে আর্তনাদ করতে করতে বলল, “একটু জল!”
আন্ট পিটি আর বাড়ির সাদা কালো সবাই মিলে, সেই ভর গরমের মধ্যে বালতি বালতি জল আর ব্যান্ডেজ নিয়ে ওদের শুশ্রূষা করতে লাগলেন। চামচে করে ওদের মুখে জল ঢেলে দেওয়া হল। ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। ব্যান্ডেজ শেষ হয়ে গেলে, ছেড়া তোয়ালে দিয়ে। আন্ট পিটি ভুলেই গেলেন যে রক্ত দেখলেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। উনি এক নাগাড়ে রুগীর সেবা করে গেলেন। শেষে ওঁর ছোট ছোট দু’পা এমন ফুলে গেল যে উনি আর দাঁড়িয়েই থাকতে পারলেন না। মেলানির গর্ভাবস্থা প্রকট হয়ে যয়ায় লজ্জায় কারুর সামনে আসত না। সেও লজ্জা ভুলে প্রিসি, কুকি আর স্কারলেটের সাথে সাথে রুগীর সেবা করে গেল। ওর হাবভাবও জখম লোকদের মতই উদ্বিগ্ন। তারপর যখন ও অজ্ঞান হয়ে পড়ল, ওকে রান্নাঘরের টেবিল ছাড়া আর কোথাও শোয়ানোর জায়গা পাওয়া গেল না। সব সোফা, সব বিছানাই এমন কি পুরো বাড়িটাই জখম সৈন্যে ভর্তি।
এই ডামাডোলের মধ্যে ওয়েডের কথা সবাই ভুলে গেছিল। সামনের বারান্দায় রেলিং-এর পেছনে অসহায় বন্দী এক খরগোশের মত ভয়ে ভয়ে মুখে বুড়ো আঙ্গুল পুরে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মাঝে মাঝে হেঁচকি তুলছিল। স্কারলেট ওকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলল, “যাও পেছনের উঠোনে গিয়ে খেলা কর!” বেচারা ভয়ে এতটাই জড়সড় হয়ে গেছিল যে মায়ের কথা সশোনা উচিত সেটাও মাথায় এলো না।
টলমলে মাথাগুলো তুলে তুলে স্কারলেট জল ঢেলে দিতে লাগল, যাতে তৃষ্ণার্ত ঠোঁট একটু ভিজতে পারে; ধূলি ধূসরিত ক্লান্ত শরীরগুলোর ওপরে আর দগদগে ক্ষত গুলোর ওপরে বালতি দিয়ে জল ছিটিয়ে দিতে লাগল, যাতে অন্তত একটুক্ষণের জন্য ওরা স্বস্তি পেতে পারে। পা টিপে টিপে অ্যাম্বুলেন্সের চালকের কাছে গিয়ে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করল, “কিছু খবর আছে? কোনও খবর?”
সবার একই জবাব, “নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে জানিনা ম্যাডাম। বলার মতো কিছুই নেই।”
ক্লান্তিতে সমস্ত পরিবেশ একটা দুঃস্বপ্নের মত লাগছে। এটা কোনমতেই বাস্তব হতে পারে না! – আর তাই যদি হয় তাহলে বলতে হবে সবাই পাগল হয়ে গেছে! তাই যদি না হবে, তাহলে আন্ট পিটির বাড়ির সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কম্পমান আলোতে মৃত্যুপথযাত্রী প্রণয়ীদের মুখে কেন জল ঢেলে দিতে হচ্ছে? এদের অনেকেই তো কোন না কোন সময় ওর প্রণয়ী ছিল। ওকে দেখে একটু হাসবার চেষ্টাও করছে! এই অন্ধকারে রাস্তার ধুলোয় কত তরুণ পড়ে আছে যারা অনেকেই ওর সুপরিচিত। আর এখন ওর চোখের সমনে ওরা মৃত্যুপথযাত্রী – ওদের রক্তাক্ত শরীরে মশা আর মাছি ভন ভন করছে। অনেকেই আছে যাদের সঙ্গে ও নেচেছে, হেসেছে, যাদের জন্য ও গান গেয়েছে, পেছনে লেগেছে, সান্ত্বনা দিয়েছে আর – আর অল্প হলেও ভালবেসেছে!
একটা গোরুর গাড়িতে অনেক লোকের তলায় ক্যারী অ্যাশবার্ণকে দেখতে পেলচাপা পড়েছে। মাথায় গুলি লেগে বেঁচে আছে কি না কে জানে! তলা থেকে বের করাও যাচ্ছে না। ছ’জন জখম লোককে আগে সরাতে হবে। ওই অবস্থাতেই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল। পরে শুনেছিল, ডাক্তার এসে দেখার আগেই ও মারা গেছে। ওকে নাকি কবর দেওয়া হয়েছিল। কোথায় কেউ বলতে পারেনি। ওকল্যাণ্ডের কবরখানায় সেই মাসে অনেককেই কবর দেওয়া হয়েছিল। তাড়াহুড়োয় অগভীর গর্ত খুঁড়ে। ক্যারীর মাথার একগাছি চুল অ্যালাবামাতে ওর মায়ের কাছে পাঠাতে না পারায় মেলানি খুবই আঘাত পেয়েছিল।
ধীরে ধীরে, রাত যত বাড়তে থাকল, প্রশ্নের জবাবগুলো ওদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। ভয়ার্ত চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকল।
“আমরা পিছিয়ে আসছি,” “আমরা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি,” “ওরা আমাদের থেকে দলে অনেক ভারী,” “ইয়াঙ্কিরা হুইলারের অশ্বারোহী বাহিনীকে ডিক্যাট্যুরের কাছে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। ওদের বিকল্প না পেলে চলবে না,” “শীগগিরই আমাদের ছেলেরা শহরে এসে পড়বে।”
স্কারলেট আর পিটি একে অন্যকে ধরে নিজেদের সামলালেন।
“ইয়াঙ্কিরা কি চলে আসছে – এসে পড়েছে?”
“হ্যা ম্যাডাম, ইয়াঙ্কিরা আসছে – ঠিক কথা – কিন্তু ওরা বেশি দূর যেতে পারবে না।” “ভয় পাবেন না ম্যাডাম, ওরা অ্যাটলান্টা দখল করতে পারবে না।” “আমরা সারা শহর জুড়ে প্রাচীর তুলে দিয়েছি।” “আমি বুড়ো জো কে বলতে শুনেছি, ‘আমি থাকতে কোনদিনই অ্যাটলান্টা দখল করতে পারবে না’।” “কিন্তু এখন তো আর বুড়ো জো নেই। এখন যিনি আছেন____” “এই চুপ কর, বোকা কোথাকার! তুই কি এই ভদ্রমহিলাদের ভয় পাইয়ে দিতে চাইছিস?” “না ম্যাডাম, ইয়াঙ্কিরা কখনও এই শহরের দখল নিতে পারবে না।” “আচ্ছা ম্যাডাম আপনারা ম্যাকন বা অন্য কোন নিরাপদ জায়গায় চলে যান না ওখানে আপনাদের কোন আত্মীয় থাকেন না?” “ইয়াঙ্কিরা অবশ্য অ্যাটলান্টা দখল করতে পারবে না। তবু যখন ওরা চেষ্টা করবে, সেই সময়টা মহিলাদের অন্য জায়গায় গিয়ে থাকাটাই বোধহয় ভাল।” “ওই সময় জোরদার গোলাগুলির লড়াই চলবে।”
মাত্র কয়েকদিন আগে নাগরিক সুরক্ষা বাহিনী নতুন ইউনিফর্মে সুসজ্জিত হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে গেল। আজ এদের ময়লা আর আলুথালু পোশাক দেখে সাধারণ সৈন্যদের থেকে আলাদা করে চেনবার উপায় নেই। কেন ওরা তিন বছর লড়াইয়ের ময়দান থেকে দূরে থেকেছে – নাগরিক সুরক্ষার নামে যুদ্ধক্ষেত্রের দুঃখকষ্ট এড়িয়ে গেছে – এসব প্রশ্ন আজ অবান্তর। অনেকেই হয়ত কষ্টকর মৃত্যুকে এড়িয়ে গিয়ে সহজ জীবন বেছে নিয়েছিল। আজ অবশ্য কেউ বলতে পারবে না যে ওদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই – হোক না সেটা খুবই অল্প সময়ের। তবুও তো অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাই এরা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য। ভিড়ের মধ্যে এদের চোখ চেনাপরিচিত বন্ধুবান্ধবের খোঁজ করতে লাগল। চেনা মুখ দেখতে পেলে গর্বের হাসিতে মুখ ভরে গেল। হ্যা এখন ওরা মাথা তুলে দাঁড়াবার অধিকার অর্জন করতে পেরেছে।
বৃদ্ধ ব্যক্তিরা আর হোমগার্ডের ছেলেরা মার্চ করে এগোতে থাকল। বৃদ্ধরা কোন রকমে পা চালাচ্ছিলেন। কমবয়সীদের চোখে মুখেও ক্লান্তির ছাপ। স্কারলেট ফিল মীডকে দেখতে পেল। ময়লা আর বারুদের গুড়ো লেগে মুখ এত কালো হয়ে গেছে যে ওকে চেনাই যাচ্ছে না। তাছাড়া ক্লান্তি আর মানসিক ধকলে কিছুটা আড়ষ্ট। বৃষ্টির মধ্যে টুপি ছাড়া আঙ্কল হেনরি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছেন, এক টুকরো পুরোনো অয়েলক্লথের গর্ত দিয়ে মাথাটা দেখা যাচ্ছে। গ্র্যাণ্ডপা মেরিওয়েদার একটা কামানের গাড়িতে করে আসছেন। খালি পা ছেঁড়াখোঁড়া একটা লেপে জড়ানো। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ও জন উইল্কসের সন্ধান পেল না।
জনস্টনের অভিজ্ঞ সৈন্যরা অবশ্য ক্লান্তিহীন পদক্ষেপে, খানিক বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে এগিয়ে চলছিল – যে মনোভাব নিয়ে এরা তিন তিনটা বছর লড়াই করেছে। মনে হচ্ছিল ওরা যেন এখনও অফুরন্ত শক্তিতে ভরপুর – সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল আর ইউনিফর্ম না পরা ছেলেদের দিকে অভদ্র মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছিল। ওদের লক্ষ্য সারা শহরকে ঘিরে যে পরিখা রচনা করা হয়েছিল সেগুলো। এগুলো তাড়াহুড়ো করে খোঁড়া অগভীর খাদ নয়, বরং বুক সমান উঁচু মাটির বাঁধ, বালির বস্তা আর ছুঁচলো কাঠের পাটাতন দিয়ে ঘেরা। এই সব পরিখা সারা শহরকে মাইলের পর মাইল ঘিরে রেখেছে যেন অপেক্ষায় কবে ওদের আবার ভরাট করে ফেলা হবে।
জিতে আসলে জনতা যেরকম অভিবাদন জানাত, এখনও ওরা সেইভাবেই এদের অভিবাদন জানাল। সবার মনেই ভয়, কিন্তু এখন ওরা বাস্তব সত্যটা জানে – যেটা ওরা কখনও কল্পনাও করেনি সেই খারাপ ব্যাপারটাই ঘটে গেছে। যুদ্ধ এখন ওদেরই ঘরের কাছে। শহরের চিন্তাভাবনাও যেন আমূল পালটে গেছে। তাতে কোন ত্রাসের ছোঁয়া নেই, নেই কোন উদ্ভ্রান্ত আচরণ। মনের মধ্যে কি চলছে, সেটা মুখে কেউ প্রকাশ করছে না। সবাইকেই বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছিল, যদিও তার অনেকটাই মনের জোরে। প্রত্যেকেই একটা সাহসী মনোভাব বজায় রেখে ট্রুপকে স্বাগত জানাচ্ছিল। বুড়ো জোয়ের কথাটাই সবাই বার বার বলছিল, ‘আমি থাকতে কোনদিনই অ্যাটলান্টা দখল করতে পারবে না।’
হুডকেও যখন শেষমেশ পিছিয়ে আসতে হল, তখন সেনাবাহিনীর মতই অনেকেই মনে মনে চাইছিল যে বুড়ো জোকে যদি আবার ফিরিয়ে আনা যেত। অবশ্য মুখে সে কথা কেউই বলল না, শুধু ওঁর কথা থেকে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করছিলঃ
‘আমি থাকতে কোনদিনই অ্যাটলান্টা দখল করতে পারবে না’!
জনস্টনের মত সাবধান হয়ে যুদ্ধ করা হুডের ধাতে ছিল না। ইয়াঙ্কিদের উনি পুবদিক থেকে আক্রমণ করেছিলেন, এমনকি পশ্চিমদিক থেকেও। শেরম্যান সারা শহরটাকে একজন কুস্তিগিরের মত জাপটে ধরেছিলেন। হুড রাইফেল পিটের পেছনে কখন শেরম্যানরা আক্রমণ করবেন সেই অপেক্ষায় বসে থাকেন নি। উনি সাহসের সঙ্গে ওদের সাথে সামনাসামনি লড়াই করেছেন। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে অ্যাটলান্টা আর এজ়রা চার্চে যে লড়াই হয়েছিল, তার তুলনায় পীচট্রীর খাঁড়ির যুদ্ধকে একটা সাধারণ দাঙ্গা বলেই মনে হবে।
ইয়াঙ্কিরা তবুও দমে গেল না। বার বার ফিরে আসতে লাগল। অনেক ক্ষতিই ওদের হয়েছিল। সেই ক্ষতি পূরণ করে নেবার জোরও ছিল। এর মধ্যেই তোপ দেগে অ্যাটলান্টা্র অনেক বসবাসকারীকে মেরে ফেলল। ঘরের ছাদ ভেঙ্গে দিল। রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় গর্ত তৈরি করে দিল। শহরবাসীরা যতটা সম্ভব নিজেদের বাঁচানোর জন্য মাটির তলার সেলারে, গর্তের মধ্যে আর রেল লাইনের ধারে অগভীর পরিখার মধ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হল। অ্যাটলান্টা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল।
পরিচালনার দায়িত্ব নেবার এগারো দিনের মধ্যে জেনারাল হুড প্রায় ততজন সৈন্য হারালেন যতজন সৈন্য জনস্টন তাঁর চুয়াত্তর দিনের লড়াই আর পশ্চাদপসরণে হারিয়েছিলেন। অ্যাটলান্টা এখন তিন দিক থেকে পরিবেষ্টিত।
অ্যাটলান্টা থেকে টেনেসি পর্যন্ত রেলপথ পুরোটাই এখন শেরম্যানের দখলে। তাঁর বাহিনী এখন রেলপথের পূর্বদিকে অবস্থান করছে। এছাড়া তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের অ্যালাবামাগামী রেলপথকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। ম্যাকন আর স্যাভান্নাগামী দক্ষিণের রেলপথই একমাত্র চালু রয়েছে। শহরে সৈন্যদের ভিড়, যাদের বেশির ভাগই ঘায়েল, উদ্বাস্তুরাও এসে আশ্রয় নিয়েছে। এর ফলে এই একটা মাত্র রেলপথ অবরুদ্ধ শহরের সমস্ত প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম। তবুও যতক্ষণ এই রেলপথকে মুক্ত রাখা যাবে, ততক্ষণ অ্যাটলান্টা রুখে দাঁড়াতে পারবে।
এই রেলপথের গুরুত্ব বুঝতে পেরে – বিশেষ করে শেরম্যান যে এখন মরিয়া হয়ে এই রেলপথ দখল করবার চেষ্টা করবেন আর হুডও কতটা মরিয়া হয়ে লড়াই করে সেটা রক্ষা করার চেষ্টা করবেন – এটা বুঝে স্কারলেট খুব ভয় পেয়ে গেল। এটাই সেই রেলপথ যেটা কাউন্টির মধ্য দিয়ে, জোন্সবোরোর মধ্য দিয়ে যায়। টারা জোন্সবোরো থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে! মনে হল টারা অ্যাটলান্টার নরকের তুলনায় অনেকটাই নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু টারা জোন্সবোরো থেকে মাত্র পাঁচ মাইল!
অ্যাটলান্টায় যুদ্ধ যেদিন শুরু হল, অনেক মহিলার সঙ্গে স্কারলেটও ছাতা মাথায় স্টোরের ছাদে বসে, লড়াই দেখল। তারপর রাস্তায় বোমাবৃষ্টি শুরু হতেই সেলারে পালিয়ে গেল। সেই রাত থেকেই মহিলা আর শিশুদের শহর থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া শুরু হল। প্রায় প্রত্যেকেরই গন্তব্য ছিল ম্যাকন। সে রাত্রে যারা ট্রেনে চেপে বসল, এর আগেও ওরা পাঁচ ছ’বার উদ্বাস্তু হিসেবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে – সেই যখন জনস্টন ডালটন থেকে পিছিয়ে এসেছিলেন। ওরা যখন অ্যাটলান্টায় এল, তখন ওদের সাথে যে পরিমাণ জিনিষপত্র ছিল, সেই তুলনায় এখন ওদের বোঝা অনেকটাই হাল্কা। ওদের হাতে একটা কার্পেটের ব্যাগ আর রুমালে মোড়া অল্প কিছু খাবার। এখানে সেখানে, দু’চারজন সন্ত্রস্ত চাকরবাকরেরা রুপোর একটা দুটো কলসি, ছুরি, কাঁটা, পারিবারিক ছবি – মানে প্রথমবার লড়াইয়ের সময় যা বাঁচাতে পেরেছিল – সেই সব নিয়ে রওয়ানা হল।
স্কারলেটের অবশ্য ম্যাকন যাবার কোন ইচ্ছেই নেই। তার থেকে বরং অ্যাটলান্টা ভাল – যদিও বোম পড়াতে ভয় ও যথেষ্ট পেয়েছে। আসল কারণ হল ও মিসেজ় বারকে আন্তরিকভাবে অপছন্দ করে। অনেকদিন আগে, উইল্কসদের কোন পার্টিতে স্কারলেটকে তাঁর ছেলে উইলিকে চুমু খেতে দেখে বলেছিলেন যে ও ‘চরিত্রহীন’ মেয়ে। ও আন্ট পিটিকে জানিয়ে দিল যে না ও টারাতে, নিজের বাড়িতে যাবে। মেলি ইচ্ছে করলে ওঁর সাথে ম্যাকন যেতে পারে।
এটা শুনে মেলানি তো ভয় পেয়ে কেঁদেই ফেলল। আন্ট পিটি ডঃ মীডেকে ডেকে আনার জন্য বেরিয়ে যেতেই ও স্কারলেটের হাত ধরে মিনতি করলঃ
“তুমি আমাকে একলা ফেলে টারায় চলে যেওনা, বোন। তুমি না থাকলে আমি একা হয়ে যাব। ওহ স্কারলেট বাচ্চা হওয়ার সময় তুমি কাছে না থাকলে আমি মরেই যাব! আমি জানি – জানি যে আন্ট পিটি আছেন – উনি খুবই ভাল। কিন্তু ওঁর তো কখনও বাচ্চা হয়নি – আর মাঝে মাঝে উনি আমাকে ভয় পাইয়ে দেন – এত ভয় পাইয়ে দেন যে মনে হয় চীৎকার করে উঠি। আমাকে ফেলে যেওনা সোনা। তুমি আমার বোনের মত, আর তাছাড়া,” একটু ম্লান হেসে বলল, “তুমি অ্যাশলেকে কথা দিয়েছ না যে আমার যত্ন নেবে? আমাকে বলেছিল যে ও তোমাকে বলবে।”
“হ্যা,” স্কারলেট খুব সংক্ষেপে জবাব দিল, “কথা আমি সত্যিই দিয়েছি, আর আমি সে কথার খেলাপ করব না। তবে ম্যাকনে আমি যাব না। আর ওই শয়তান বুড়ি বারের সাথে থাকতেও পারব না। তাহলে হয়তো পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওর চোখ খুবলে নেবার জন্য হাত নিশপিশ করবে! আমি টারায় ফিরছি। তুমিও আমার সাথে আসতে পার। মা তোমাকে পেলে খুশিই হবেন।”
“ওহ সেটা আমার খুবই ভাল লাগবে। তোমার মা আমাকে খুব ভালবাসেন। কিন্তু তুমি তো জানো আন্টি বাচ্চা হওয়ার সময় আমার কাছে না থাকতে পারলে খুব দুঃখ পাবেন। আর উনি টারায়ও যাবেন না – কারণ টারা লড়াইয়ের জায়গা থেকে বেশি দূরে নয়। উনি একটু নিরাপদ জায়গায় যেতে চাইছেন।”
আন্ট পিটির জরুরি তলব পেয়ে ডঃ মীড হাঁপাতে হাঁপাতে চলে এলেন। উনি ভেবেছিলেন হয়ত মেলানির আগেভাগেই প্রসববেদনা শুরু হয়ে গেছে। এতে উনি খুবই রেগে গেলেন আর সেটা বলতেও ছাড়লেন না। তারপর যখন আসল কথাটা শুনলেন, তখন উনি যে বিধান দিলেন, তাতে নড়চড় করার কোন উপায় থাকল না।
“এখন তোমার ম্যাকনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, মিস মেলি। যদি যাও, তাহলে আমি তোমার দায়িত্ব নিতে পারব না। ট্রেনগুলো যেরকম ভিড় হচ্ছে – আর যেরকম অনিয়মিতভাবে চলাফেরা করছে – ওর যে কোন সময়ে তোমাদের মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে জখম ট্রুপ কিংবা মালপত্র নেবার জন্য চলে যাবে। তোমার এরকম অবস্থায় ____”
“যদি আমি স্কারলেটের সঙ্গে টারায় চলে যাই ____”
“আমি বলে দিলাম – আমার একদম ইচ্ছে নয় যে তুমি এখন কোথাও যাও। টারা যাবার ট্রেনই ম্যাকন যাবার ট্রেন। তাই সেটারও একই অবস্থা। তাছাড়া ইয়াঙ্কিরা এখন কোথায় আছে কেউ জানেনা। তোমাদের ট্রেন দখল হয়ে যেতে পারে। আর ধর জোন্সবোরো নিরাপদে পৌঁছে গেলে, তারপর প্রায় পাঁচ মাইল এবড়োখেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে টারায় পৌঁছাবে। এই অবস্থায় কোন মেয়ের পক্ষে এভাবে যাওয়া ঠিক নয়। তাছাড়া ওই কাউন্টিতে এখন কোন ডাক্তারও নেই। ডঃ ফোনটেন যুদ্ধে চলে গেছেন।
“কিন্তু ধাইরা তো আছে ___”
“আমি ডাক্তারের কথা বলেছি,” একটু অসহিষ্ণু হয়ে বললেন। ওঁর নজর অচেতনভাবে পড়ল ওর রুগ্ন শরীরটার ওপর। “এখন তোমার কোথাও যাওয়া হবে না। সেটা বিপদ ডেকে আনতে পারে। তুমি নিশ্চয়ই চাওনা তোমার বাচ্চার জন্ম ট্রেনে কিংবা ঘোড়ার গাড়িতেই হয়ে যাক, চাও কি?”
চিকিৎসাজনিত এই অসঙ্কোচ মেয়ে দুজনকেই বিব্রত করে ফেলল, ওদের বাকস্ফুর্তি হল না।
“তোমার সাথে আমি খোলাখুলি কথা বলব, মিস স্কারলেট,” সাদা দাড়ি ঝাঁকিয়ে শুরু করলেন। “তোমার বয়স কম হলেও বুদ্ধিশুদ্ধি আছে বলেই মনে হয়। তাই তুমি লজ্জাটজ্জা পেয়ে বোসো না আবার। মিস মেলির নড়বার ব্যাপারে কোন কথা আমি শুনতে রাজী নই। যাতায়াতের ধকল ও সহ্য করতে পারবে কি না সে নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে ও যাচ্ছে। পরিস্থিতি ঠিকঠাক থাকলেও – কোমরের কাছটা যেরকম সরু –ফোরসেপের প্রয়োজন হতে পারে প্রসব করানোর জন্য। তাই আমি কোন আনাড়ি নিগ্রো ধাইএর ওপর ভরসা করতে চাই না। ওর মত মেয়েদের বাচ্চা না হওয়াটাই ঠিক কিন্তু – সে যাক গে, তুমি মিস পিটির বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে ওঁকে ম্যাকন পাঠিয়ে দাও। যেরকম ভীতু মানুষ, মিস মেলিকে আরও ভয় পাইয়ে দেবেন। হিতে বিপরীত হতে পারে। আর হ্যা মিস,” খুব তীক্ষ্ণদৃষ্টি দিয়ে ওকে ভেদ করে বললেন, “তুমি বাড়ি চলে যাচ্ছ একথাও আমি শুনতে চাই না। যতদিন বাচ্চাটা না আসে, মিস মেলির সঙ্গে সঙ্গে থাক। ভয় পাচ্ছ না তো?”