জয়শ্রী সরকারের গল্প: বিজয়া টকিজ
পাড়াটা কেমন পাল্টে গেছে।ভাবতে ভাবতেই নিখিলেশ ফুল্লুদের বাড়ির সামনে এসে থামলো।ফুল্লু তার খেলার সাথী ছিল। সমবয়সীদের মধ্যে ঐ প্রথম সাঁতার শিখেছিল। দেখতে রোগা পটকা হলেও গায়ে বল ছিল। মুরগীর লড়াইয়ে একে ওকে গুতিয়ে ফেলে দিত। যতদূর তার মনে পড়ে এই বাড়িটাই তাদের। টিনের চৌচালা পাল্টে হাফ বিল্ডিং হয়েছে। সবুজ ঘাসের যে বিশাল একটি উঠোন ছিল সেও সিমেন্টের অতলে ডুব মরেছে। নিখিলেশ এদিক ওদিক উঁকি দিয়ে গৃহস্থকে দেখার চেষ্টা করে। একটা টোপর দোলানো মুরগী ছাড়া কাউকে দেখা যায়না।
কসাই পুকুরের সাথেও দেওয়ালের বিলের সংযোগ ছিল। বর্ষাকালে এইপথে মগড়া থেকে পাটবোঝাই নৌকা দেয়ালের বিল হয়ে কসাই পুকুরে আসতো এসে ভিড়ত। মাঝিরা ঘাটে রান্না করতো। রাতে ভেসে আসতো তাদের ভাটিয়ালি সুর। মাঝরাতে ইলিশ মাছের গন্ধে ম ম করতো চারদিক। কতদিন ইলিশ মাছের গন্ধে ঘুম ভেঙ্গেছে। ‘বুঝছোগো ভাই, তুমার মনে নাই। আমার চোক্ষে ভাসে খালি. . . . . .’
সেইসব দৃশ্য ছিল নিখিলেশের ঠাকুমার চোখে দেখা। তাই বলতে বলতে চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে যেত।
ঐতিহাসিক এই পুকুরগুলো এখন মরিমরি করছে। প্রকৃতিখেঁকোরা উন্মাদ হয়ে গেছে সর্বত্র। ভাতমাংস খেয়ে ওদের পেট ভরেনা। তখন পুকুর খায়, নদী খায়, বৃক্ষ খায়, পাহাড়-পর্বত সব খায়। এখানে এরা পুকুর খেয়েছে। যে পথে মগড়া হয়ে বিল থেকে পাটের বহর এসে ঢুকতো সেই পথগুলি আটকে দিয়েছে। ড্রেনের মত নালা আটকে দিয়েছে লাভের আশায়। বিশ্বেশ্বরীর জল খাবার কথা শুনলে মানুষ হাসবে। জারমুনিতে ভরে থাকে সে। ময়লা ভাসে। নিউটাউনের ডাস্টবিন এখন এই তিনটা পুকুর। একটু পয়সাওয়ালা বাড়ির মানুষ ঘাটে স্নান বা জলের জন্যে আসেই না। ফলে তারা নষ্ট করে মনখুলে। লাল শাপলার বদলে ভেসে থাকে সভ্য জীবনের আর্বজনা। পুস্কনির উপরে মুরগীর খামার। নৌকার বদলে এখন ময়লা আর্বজনা ভেসে যায়।
নিখিলেশের স্মৃতিতেও যে পুস্কুনি সেই-ই নেই! আর মেনকাদেবী কিচ্ছার পুস্কুনি তো অনেক দূরের কথা। সময়ের সাথে তাদের মনোহর নামও পাল্টেছে। স্থানীয়রা বিশ্বেশরীকে বলে বড় পুস্কুনি, কসাই পুকুরকে পঁচা পুস্কুনি, অনন্ত সাগরকে নিউটাউন পুস্কুনি। আর ঐ দিকে দেওয়ালের বিলে এখন আর জল নেই। ইটের খলা, তেলের পাম্প, বসতবাড়ি বিলকেও গিলে খেয়ে নিয়েছে। পাটের বহর, রুপালী মাছ, রিজার্ভ ট্যাংক, লাল শাপলা, মাঝির গান সবই এখন রূপকথা, রূপকথা বিশ্বেশ্বরী, অনন্ত সাগর, কসাই পুকুর।
স্মৃতির ভাঁজে স্মৃতি ডানা ঝাপটায়। স্বদেশে এসে আজ কতবছর পর ঠাকুমার কথা মনে পড়ে গেল। ভিটার জন্যে কি ছটফটই না করেছে বুড়ি। মৃত্যুর আগে বড়ছেলেকে একদিন কাছে ডেকে বললেন,
আচ্ছা, এতকাল পর অস্থিটা নিশ্চয়ই নেই বা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। থাকলে ঐটাও কি সে নিয়ে যেতে পারেনা-ভাবে নিখিলেশ! পরক্ষণের ভাবে, যেখানে বাড়িতে ঢোকার পথই মিলছেনা সেখানে এতকিছু চিন্তা করা বৃথা।
গাড়ির হর্ন বাজলো। নিখিলেশ উঠে দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি নেয় গেইটের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। গাড়িটি ততক্ষণে গেইটের ভিতরে ঢুকে গেছে। নিখিলেশ উঠে যেতে যেতে দারোয়ান গেইট লাগিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি শেষ করেছে। অবশ্য পলকের দেখা মিললো অন্দরের। চালতা গাছটি দিব্বি রয়েছে। প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে সে গাছ রাস্তা থেকেই নজর কাড়ছে অথচ এতক্ষণ নজরেই আসেনি নিখিলেশের। ঘরগুলো পলিশ হয়েছে কিন্তু পাল্টায়নি তো। সেইতো লাল ইটের বাড়িই আছে। নিখিলেশের হৃদয় খুঁড়ে হুড়মুড়িয়ে কতকি বেরিয়ে আসছে।
হ্যাগো বাবা, চালতা গাছে চালতা ধরতে কতদিন লাগে?
মিত্রমশাই কিছু বলার আগে বিজয়া দেবী চাপা স্বরে ভেংচি বলে, আর যদি এদিক ওদিকে গেছিস পায়ের নলি ভেঙ্গে দেবো তোর। মায়ের ভয়ে খুকি পালঙ্কে গিয়ে শুইয়ে চোখ বুজে। মিত্রমশাই খেয়ে মেয়ের কাছে গিয়ে বসতেই খুকি উঠে বসে। ঘুম আসছে না তার। বিজয়দেবীও হেঁসেল গুছাতে চলে গিয়েছিল। সুযোগ পেয়ে খুকি চালতা ফুলের চারা কিভাবে সে বৃষ্টির মধ্যে আবিস্কার করলো, কিভাবে তা প্রতিস্থাপন করা হলো সেইসব শুনালো। মেয়েকে খুশি করতে মিত্রমশাই পরদিনই চটি দিয়ে চারদিকে বেড়া তুলে দিয়েছিল। এই সেই চালতা গাছ। কিন্তু তার দিদিটা কই গেল? বেঁচে আছেতো?
অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও সে দিদির মুখখানা মনে করতে পারলো না। সব আবছা, টুকরো টুকরো মনে পড়ে কিন্তু তাকে জড়ো করে ঠিক মুখশ্রীটা মনে করতে পারেনা। কিন্তু সে মুখের কথা সে ভাবছেই বা কেনো! যে সর্বনাশ তার জন্য সকলের হয়েছে। নিখিলেশ খুকিকে নিয়ে ভাবনাটা মন থেকে ঠেলে বের করে দিতে চায়। অন্যসব স্মৃতি দিয়ে দিদিকে পাশ কেটে চলে যেতে চায়।
অথচ নিষিদ্ধ আর্কষণের মত দিদিও তার পিছু ছাড়ছে না! এতক্ষণ যে গাছটি তার চোখেও পড়েনি। এখন বারবার সেই কেমন নজর কাড়ছে। কোন কোন সম্পর্ক হৃদয়ের বামপাশটায় চুপটি করে লুকিয়ে থাকে। না চাইলেও সহসাই তারা জাপটে ধরে। ঠেলে বের করে দিতে চাইলেও নড়তে চায়না।
ত্যাগ করা আর ভুলে যাওয়ার অর্থ কি এক! নাতো। দিদির কথা মুখে নেবার দায়ে শাস্তি দেবার জন্যে আজ কেউ আর বেঁচে নেই। তবে ভয় কি! মনে যদি পড়ে, পড়ুক। মা ঠাম্মা কাকীমা লুকিয়ে কত কেঁদেছে। বাপ কাকারা বুঝিয়েছেন ভুলে গেছে কিন্তু ভুলতে কি সত্যিই পেরেছেন! কি যে সব ঘটেছিল আজ তা স্পষ্ট করে মনে পড়েনা। শুধু দিদি হঠাৎ নেই।
টকিজে তখন রুব্বান সিনেমাটি চলছে। হাউজফুল ব্যবসা। খবর পেয়ে ছুটে এলেন বাবা কাকারা। তারপর কাকপক্ষিটি টের পাওয়ার আগেই সব ছেড়েছুড়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে গেল। তারপর কলকাতা মেইলে ছুট।
এত সম্পদ রেখে গিয়ে উঠতে হলো একটা ঘুপচি ঘরে। মালিক বনে গেল ভাড়াটিয়া। বিশাল সিনেমাহলের মালিকদের রোজগারের জন্য কি লড়াইটা না করতে হয়েছে। সেসব দিনের কথা মনে হলে দিদির প্রতি বিষাদে মন ছেয়ে যায় তার। ভাবে, কি দরকার ছিল! নিখিলেশ তখন শিক্ষা-দর্শন ভুলে প্রথাগত বিশ্বাসের ঘোরে পড়ে যায়। এ নিয়ে আজ কত যুগ ধরে সে যুদ্ধ করছে! মুক্তিতো মিলছে না। কলকাতার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে শিক্ষকতা করেছে। কয়েকবছর হলো রিটায়ার্ড করেছে। মতের স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। তবু নিজের দিদির প্রসঙ্গ আসলেই কেমন সংস্কারে ডুবে যায় সে।
যেকোন বিষয়ে সে ভীষণ শান্ত ও স্থির। স্মৃতিকাতর হয়ে সব যেন বিসর্জন দিতে বসেছে। নিখিলেশ এবার নড়েচড়ে বসে। একবার কাউকে জব্বার ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করা যায়। অনেকের নাম সে গল্পে গল্পে শুনেছে। রবীন্দ্র শর্মা, সুশীল পাল, ঠাকুরবাড়ি। উনাদের একটু খোঁজ করলে পাওয়া হয়তো যাবে। সময়ও বেশি নেই হাতে। এর মধ্যেই তাকে যা চায় খুঁজতে হবে।
তবে তার আগে সিনেমাহলে একবারটি যাবে। ভুল না হলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হাতের ডানপাশের রাস্তাটা ধরে এগোলে পুকুরের কোনায়ই টকিজটি ছিল। নিখিলেশ পশ্চিমদিকের পথটি ধরে এগিয়ে যায়। বেশভূষায় অচেনা ছয় সাতটা বাড়ি পেড়িয়েই সেই লাল ইটের পুরনো বাড়িখানা দেখে। ঠিকই আছে। এইপথেই সিনেমাহল। কিন্তু তেমাথার এপার ওপারে তেমন কোন বিল্ডিংই তার চোখে পড়েনা। দোকানপাট বলতে দুইখানা চায়ের দোকান ছাড়া কিছু নেই। নিজেরও ভুল হতে পারে ভেবে কাউকে একটু জিজ্ঞাসা করবে কিনা বারকতক ভাবে। মোড়ে চায়ের একটা দোকানই খোলা। কয়েকটা অল্প বয়সের ছেলে বসে বিড়ি টানছে আর মিছিল টিছিল নিয়ে কথা বলছে। তাদের আলোচনাতেই নিখিলেশ বুঝতে পেল, গতকাল শহরে কোথাও একটা পার্টির সমাবেশকে ঘিরে সংঘর্ষ হয়েছে। শহর তাই থমথমে।
নিখিলেশের একবার এখানকার পার্টির এক্টিভিজম নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সাহস হয়না। দুইবাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি মন্দা। সেসব তো এখন চাপা থাকেনা। নেহাতেই বাবার কাজটা থেমে আছে, তাই সব বারণ উপেক্ষা করেও সে এসেছে। তন্দ্রার সাথে এ নিয়ে তার মনোমালিন্য হয়েছে একচোট। শেষে মেয়ে সাপোর্ট দেয়ায় আসার অনুমতিটা পেয়েছে। তবু সঙ্গে নাতি এসেছে। নিজদেশে পরদেশী আর পরদেশে অধিবাসী এই টানাপোড়নটায় সে আর কোন বিপদ বাড়াতে চায়না। এসব ভাবনাই নিখিলেশের আশায় ছাই ছাপা দেয়। ছেলেগুলো নিখিলেশের মনের কথা বুঝতে পারেনা। ওরা ওদের মত খাওয়া শেষ করে বিড়ির ধোঁয়া উড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গেল।
নিখিলেশ বসে আছে। চুলায় কয়লা গুঁজতে থাকা ছেলেটিকে নিখিলেশ বলে, এককাপ চা হবে বাবা?
লোকটির কথা শুনেই দুলু বুঝতে পারে লোকটি বোধহয় বাইরে থেকে এসেছে। তাছাড়া এবাংলা ওবাংলার ভাষা খাবার এইগুলো সম্পর্কে সকলেরই কমবেশী ধারণা রয়েছে। সে মাথা নেড়ে বলে, হবে, হবে। কই আইছুইন দাদু? নিখিলেশ উদাসচোখে শূন্য মাঠটার দিকে চেয়ে আছে। যেন সে ছেলেটির কথা শুনতেই পায়নি। দুলু চায়ের কাপের চিনি নাড়তে নাড়তে আবার জিজ্ঞাসা করে কাওরে খুঁজতাছুইন?
নিখিলেশ এবার শুনতে পায়। সে আমতা আমতা করে বলে এখানে কোথাও কি একটা সিনেমাহল ছিল?
হু, আছিন তো।
এরপর লুঙ্গিতে ভেজা হাতটি মুছতে মুছতে ছুটে আসে টেবিলের দিকে। টেবিলের সামনে কয়েকটা ফাঁকা কাপ, বনরুটির টুকরো আর বিড়ি সিগারেটের ছাই পড়ে ছিল। নিখিলেশের সৌজন্যে সে টেবিলটা দ্রুত মুছে নিয়ে চায়ের গ্লাসটি রাখে।
হল একটি আছিন। কাগজপত্রে হাসনা টকিজ নাম। এলাকাত পুরান সিনেমাহল কয়। ঐ হিরামনের আগেই তো হলটা, হেরলাইগ্যা। তা সেই সিনেমাহল ভাইঙ্গা দিছে কয়েকবছর। ঘরেই সিনেমা দেহে সব, হলে কেউ আয়েনা। সিনেমা হল নাই কিন্তু পুরান সিনেমাহল কইলে অন্ধও আপনেরে এই মোড়ে নামাইয়া দিয়া যাইবো।
নিখিলেশ মাত্রই চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। সিনেমাহলটাকে ভেঙ্গে দিয়েছে শুনে মনে হল তার মাথার ভিতরে কেউ যেন হাতুড়ি শাবল দিয়ে খুঁড়ছে। সেখান থেকে ইট সিমেন্টের আস্তর খুলে খুলে পড়ছে। তার মনে পড়ে, মালকোচা দিয়ে ধবধবে সাদা ধূতি আর গরদের পাঞ্জাবী পরে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বিশাল পোস্টার। পোস্টারে কত নায়ক নায়িকা ভিলেনরা নানা ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে। পাশেই ইটের দোতলা। ক্ষণে ক্ষণে বেল বাজছে। রাস্তামুখী ছোট্ট ঘরটায় প্রজেক্টার মেশিন। মেশিনটা ভূমমমভূমমম করে স্টার্ট নিচ্ছে। সমগ্র পাড়ায় সে শব্দ ছড়িয়ে যাচ্ছে। দুইভাই দিদি কাকার সাথে মেশিন ঘরে সে দাঁড়িয়ে। মেশিনটা চালু হতেই একছটা ফিল্মিআলোর রশ্নি ধেইধেই করে দেয়ালের সুরঙ্গ পথ ধরে সামনের বিশাল পর্দায় আছড়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে মিউজিক।মিউজিকের সাথেসাথে ঝিকঝাক অক্ষরের নাম। কত ঢঙেই না আসছে যাচ্ছে। নাম শেষ হলেই বহু প্রতীক্ষার নায়ক নায়িকারা পর্দায় আসবেন। পর্দার সামনে সারি থেকে হৈ হৈ আনন্দের রব ভেসে আসবে।
সেসব স্মৃতির বেদনায় বাবাটাই তার কেমন হয়ে গেল। এরপর আর কোনদিন প্রাণখুলে তাকে হাসতে কেউ দেখেনি। কোনদিন সিনেমাহলমুখী হননি। আজীবন শেষ শো ভাঙ্গার সময় পর্যন্ত জেগে থাকতেন। মুখফুটে কোনদিন বলেননি। সকলেই জানতো কেন তিনি ঘুমাননা। নিখিলেশ গ্লাসের চা শেষ না করেই বসে থাকে। দোকানে কেউ আর নেই। রাস্তাগুলো ফাঁকা। শহরে অবরোধ চলছে। শুনশান পরিবেশ তার ব্যথাকে উস্কে দিল। নিখিলেশ পকেট থেকে মানিব্যাগটি বের করে ছেলেটির হাতে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট গুজে করে দেয়। চায়ের দাম রেখে বাকি টাকা ফিরত দিতে গেলে সে তাকে রেখে দিতে ইশারা করে।
শোন, সিনেমাহলটি যেখানে ছিল সে জায়গায়টা একটু দেখিয়ে দিতে পার? দুলু বিশাল একটি দায়িত্ব পাওয়ার ভঙ্গিতে নিখিলেশের সাথে বেড়িয়ে এক লাফে রাস্তাটার ওপাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়।
এইযে এইখানেই তো আছিন। ইস কত সিনেমা দেখছি। আমরার টেকা লাগতোনা। সিনেমা শুরু হইলে ম্যানেজার মামারে কইয়া চিপাচাপা দিয়া ঢুইকা দেখতাম। এই দোকানটা তহন আমার বাবা করতো বুঝলেন। আইচ্ছা আপনে কেডা?
নিখিলেশ চমকে ওঠে খানিক। এর উত্তরে কি বলবে সে? সেকি বলবে, সিনেমাহলের আসল নামটি যার আমি তারই ছেলে! ভাবতেই ভাবতেই অস্ফুট স্বরে বলে আমি নিখিলেশ মিত্র! তারপর এগিয়ে যায়। ওর মনে তখন কি চলছিল তা ঠাওর করা দুলুর পক্ষে সম্ভব হয় না। সে দাঁড়িয়ে থাকে। পা যেন মাটির সঙ্গে এঁটে গেছে। সরছে না। জীবনে অতল থেকে স্মৃতি খুঁড়ে আনে। এরপর নিচু হয়ে এক চিমটি মাটি তুলে নেয়। পকেটে রাখা ছোট্ট একটি কৌটায় নিয়ে আবার পকেটেই রাখে। এবার ভিটের একটু মাটি নিলেই তার কর্তব্য শেষ। কিন্তু বাবা কি শুধু মাটির জন্যেই তাকে দিয়ে অমন প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন? নাকি ভিন্ন চাওয়াও ছিল?
খুকিকে সে চোখে হারাতো। মুখ ফুটে সে কথা হয়তো বলেন নি। কিন্তু হিউম্যান সাকোলজির বিদ্যা বলে না যে মানুষ মন থেকে সব মুছে ফেলতে পারে। নিখিলেশেরও তাই বিশ্বাস। এখনো হাতে একটা দিন রয়েছে। কাল আবার সে এখানে আসবে। জব্বার ভাইকে পেয়ে গেলেই একটা না একটু ক্লু সে পাবে।
তবে এবার তার রেস্টহাউজে ফেরা দরকার অথচ ফিরতে ইচ্ছে করে না। ওখান থেকে সরতেও ইচ্ছে করে না। ভিতরটা গুড়িয়ে যাচ্ছে। এইসব ব্যথা বইতে আর ইচ্ছে হচ্ছে না। বাবা যদি জানতো তার টকিজটি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। কি জানি সহ্য হতো কিনা! বাবা নেই, একদিকে ভালোই হয়েছে। ফিরে গিয়ে সে কি বলতো! এসব এলোপাথারি ভাবতে ভাবতে নিখিলেশ দুলুর দিকে হাসি বিনিময় করে পুরনো পথে হাঁটে।
সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। অবশ্য খিদে টিদে পায়ওনি। এক আধবেলা না খেয়ে থাকা ছোটবেলার অভ্যেস। দেশছেড়ে যাওয়ার পর কত তাপই পোহাতে হয়েছে। রোদ বৃষ্টি খিদেয় জ্বলে শরীর ইস্পাতের মত হয়ে গেছে। তা না হলে এখনো এই বয়সে সে পাহাড়ে চড়ে। সুযোগ পেলেই এদিক সেদিক হাওয়া বদলে বেরিয়ে পড়ে। তবে অন্যসব স্থানের হাওয়ার সাথে আজকের হাওয়ার বিস্তর ফারাক। কি এক ঘোর। যে ঘোরে সে এখনো হেঁটে চলেছে। ঘাটে রাত্তির নামছে। পাকা বেঞ্চিটায় নিখিলেশ এসে বসে। আকাশে সন্ধ্যা তারা। মৃত্তিকা ভবনের গ্যাটটি শুনশান। নিখিলেশ ভাবে, আর একটিমাত্র দিন! এমন সময় কেউ একজন বলে উঠে,
বইনটারে না দেইখা চইলা যাইবা খোকা!
পোড়ামুখি আবারো ভিলেনের মত চিন্তার দুয়ারে কুট মেরে বসে। রাগে ক্ষোভে নিখিলেশের সব তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। এই যে ভিটের দুয়ারে উদ্বাস্তুর মত বসে আছে এর দায় নেবে কে! আকাশে ছোপছোপ মেঘ ভেসে যায়। সেই মেঘের পাট ভেঙ্গে একটি চাঁদ চালতা গাছের মগডালে উঁকি দেয়।
সকালে চায়ের দোকানটিতে ভিড় ছিল। নিখিলেশ রিকশার ভাড়া মিটিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারী করে। কাস্টমারদের ভিড় কমলে সে দোকানে ঢুকে। দুলু তাকে দেখেই ছুটে এসে বেঞ্চির একটি কোনা মুছে দেয়। নিখিলেশ অপেক্ষা করে। তার কোন তাড়া তো নেই। তাই পরে চা খাবে বলে দুলুকে বিদায় দেয়। দুলু কাস্টমারদের চা দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই দোকান প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। বিল মিটিয়ে দিয়ে সব কাজে ছুটে গেল। দুলু সুন্দর একটি কাপে করে মিস্টিরিয়াস মানুষটির জন্য চা নিয়ে আসে।
চা খেতে খেতে নিখিলেশ মানুষ দেখে। সিনেমা হলের খা খা করা শূন্য জমিটা দেখে। প্লেটে করে নুনতা দুইটা বিস্কুট নিয়ে দুলু সামনে এসে দাঁড়ায়।
বিস্কুট খাইয়া দেখেন। টেস্ট পাইবেন।
নিখিলেশ হাত বাড়িয়ে একটি বিস্কুট নেয়। দুলু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে, আইচ্ছা আফনে কেডা?
নিখিলেশ আবারো থতমত খায়। জ্ঞানের জন্য কত নামডাক অথচ এই প্রশ্নের উত্তর কাল থেকে সে দিতে পারছে না। বলতে গেলে এই ছেলেটিই তাকে একটু আধটু খাতির করছে।তার কাছে তো টুকটাক বলাই যায়। কিন্তু বলবেটা কি . . . .!
আমি আফনেরে চিনছি। এইটুকু বলে দুলু একগাল হাসি ছড়ায়।
নিখিলেশ ভ্রু কুঁচকায়।
হু। মা গপ্পো করে তো। এই সিনেমা হল একটা হিন্দু মালিকের আছিন। ঐ পুস্কনির কোনাত হেরা থাকতো।
তোমার মা বাঁইচা আছে?
আছে।
আমাকে নেবে তোমাদের বাসায়।
দুলু রাজী হয়ে যায়। দুপুরে সে তাকে নিয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেয়। নিখিলেশের মনে তড়িৎবেগে কিছু একটা খেলে যায়। নিশ্চয়ই সেসব গল্প এই জনপদে রয়ে গেছে। খুকিদি কোথায় আছে তা জেনে যাওয়ার ক্ষীণ আশা উঁকি দেয়। সে অপেক্ষা করে দুপুরের।
আজ রোদটা মৃদু। সকাল থেকেই উদাস করা বাতাস বইছে। বিশ্বেশ্বরী আনন্দে তিরতির কাঁপছে। চালতা ফুলের শাখায় দুলতে থাকা পাতা এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে। কেন যেন নিখিলেশের আর বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছেনা। কেবল এক চিমটি মাটি নিয়েই সে ফিরবে। যে জিনিস ছেড়ে গেছে তাতে মায়ায় জড়িয়ে দুঃখ আর বাড়াতে চায়না। কেবল তার মার্বেল, রথ থেকে কেনা টমটম গাড়িটা, মাঞ্জা দেয়া লাটাইটা যদি পেত তবে সঙ্গে করে নিয়ে যেত। এগুলোর জন্যে এখনো তার বড় কষ্ট।
নিখিলেশের হার্টবিটটা যেন বেড়ে গেছে। দুস্পর্শ কোন স্মৃতির সম্ভাবনায় সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। অস্বস্তি কাটাতে সে ঘরের চারদিকে চোখ বুলায়। বোঝায় যাচ্ছে ওদের এই একটি মাত্র ঘর। ঘরের ডগায়ই রান্নার চুলা। সেখানটাই মা ছেলে কিছু একটা করছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই থালায় দুটো লুচি আর বাটিতে খানিক আলুর দম ও একটি ডিম ভাজি নিয়ে ওরা ফিরে। থালাটা নিখিলেশের সামনে রাখতে রাখতে সলজ ভঙ্গিতে বলে, আগে জানলে ভাতের ব্যবস্থা করতাম। পাজি ছেরা, সকালে কয় আপনের কথা। এত বড় ঘরের মানুষ আপনি, পায়ের ধূলা দিলেন।
নিখিলেশ অপ্রত্যাশিত আপ্যায়নে কি বলবে বুঝে পায় না। শুধু ভদ্রতার জন্যে বস্তাপচা সেসব কথা তার বলতে ইচ্ছে হলোনা। যে আক্ষেপ কাল সারাদিন তাকে কুঁড়ে খেয়েছে। মুহূর্তেই সেখানে কেউ যেন শান্তিজল ছিটিয়ে দেয়েছে। অন্তত কাউকে তো সে দেশে এসে পেয়েছে যে তার জন্য কষ্ট করে লুচি ভেজেছে। নিখিলেশ হাত ধুইয়ে আলুর দমে লুচি ডুবালো। কত যুগ পর সে বাংলদেশে পাত পাতলো যেন। সে পরম আনন্দে খায়।
দুজন অচেনা মানুষ সে খাওয়া দেখে। দৃশ্যটি কিছুটা অস্বস্তির। অস্বস্তি কাটাতে নিখিলেশ জিজ্ঞাসা করল, আপনি এসব কোথায় শুনেছেন বোন?
দুলুর মা জানায় তার মায়ের মুখেই এসব গল্প সে শুনেছে। জানেনতো, মা বেঁচে থাকলে আপনাকে দেখে খুব খুশি হইতেন।
নিখিলেশের ইচ্ছে করে তার মায়ের নামটি একবার জানতে। এমন একটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক নয় ভেবে আর জিজ্ঞাসাও করে না। লুচিটা ভীষণ স্বাদ হয়েছে খেতে সেই কথা বলে। খেতে খেতে প্রসঙ্গ এগিয়ে চলে।
আচ্ছা তিনি আর কি বলতেন?
দুলুর মা এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলেনা। যেন ইচ্ছে করেই না শুনার ভান করে বেরিয়ে যায়। নিখিলেশ বুঝতে পেরে চুপ হয়ে যায়। খুকির প্রসঙ্গে কোন গল্প এ জনপদে রয়েছে কিনা সেকথা জানা হয় না তার। বিব্রতকর হাওয়া কাটাতেই নিখিলেশ দুলুর কাছে জব্বার নামে কাউকে চিনে কিনা জিজ্ঞাসা করে। দুলু লাফিয়ে ওঠে।
ঐ পুস্কনির কোনার বুড়াতো? চিনি চিনি।
কিছুক্ষণ আগে যে আশা নিভু নিভু করছিল তা ধপ করে জ্বলে ওঠে। নিখিলেশ চায়ে চুমুক দিতে দিতে তার তৃপ্তির কথা জানায়। যাদবপুরে কোনদিন গেলে যেন অবশ্যই তাদের বাসায় যায় সেই আমন্ত্রণ রেখে কাগজে ঠিকানা লিখে দেয়। তারপর প্রণাম জানিয়ে উঠে দাঁড়ান।
আকাশে শেষ বিকেলে সূর্য। নিখিলেশ মৃত্তিকা ভবনের সামনে গিয়ে থামে। প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে আসা চালতা গাছ থেকে চালতা গন্ধ আসছে। গেইটের সামনে থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে নিখিলেশ উঠে দাঁড়ায়। এমনসময় গেইটের ছিটকিনি খোলার শব্দ হয়। দারোয়ান হাতে তামাক পাতা ডলছে।
কাউকে খুঁজছেন স্যার?
নিখিশেষ মাথা নাড়তে নাড়তে যতদূর দেখে নেয়া যায় মন ভরে দেখে নেয়। দুলু এতক্ষণে অনেককিছুই জেনে গেছে। ও আগ বাড়িয়ে কিছু একটা বলতে নিলে নিখিলেশ তাকে থামিয়ে দিয়ে সামনে হাঁটে। মনে মনে বলে যাওয়ার আগে আমি আবার আসবো মা। মনেমনে এটুকু বলে দুলুর দেখানো পথ অনুসরণ করে।
তেতলা একটি বাড়ি। সামনে কোন ফুলের গাছটাছ নেই। দুলুই আগে ঢুকে বাড়িতে। নিখিলেশ বাইরে অপেক্ষা করে। জব্বার ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার অস্থিরতায় সে ঘনঘন নাকের ডগায় আঙ্গুল ঘুটে। দুলুকে আগেই সে বলেছিল, জব্বার ভাইয়ের এক ছোটভাই বিদেশ থেকে দেখা করতে এসেছে এইটুকুই যেন তাদের বলে। দুলুও সেই বলে অনুমতি নিয়ে এসে নিখিলেশকে নিয়ে ভিতরে যায়।
ছিমছাম ড্রয়িংরুম। সেখানেই তাকে বসতে বলে একটি মেয়ে। বোঝাই যাচ্ছে গৃহপরিচারিকা। দুলু তাকে রেখে দোকানে ফিরে যায়।জানায় কিছুক্ষণ পর সেই এসে নিয়ে যাবে নিখিলেশকে।দুলু চলে গেলে, মেয়েটি জানায় জব্বার মিয়া ঘুমাচ্ছেন। তাকে ডাকা হয়েছে। সে হাতমুখ ধুইয়ে আসছেন। এরপর সে কারো একটা ডাকে চলে যায় না। নিখিলেশ টেবিলে থাকা পত্রিকাটা তুলে নেয়। চোখ বুলায় কিন্তু মন লাগেনা। বাতাসে পর্দাটা কেঁপে উঠে। নিখেলেশ চমকে ওঠে। কিন্তু না কেউ নেই। তবু কানপেতে থাকে জব্বার ভাইয়ের আসার প্রতিক্ষায়।
মিনিট কুড়ি পর লাঠিতে ভর করে একজন ঢুকলেন। পরনে আকাশী রঙের একটা লুঙ্গি ও চেক কাপড়ের পাঞ্জাবী। কোমর থেকে শরীরটা নুইয়ে গেছে। মেন্দিরঙা দাঁড়ি কঙ্কালসার শরীরটাতে অতিরিক্ত বলে মনে হয়। নিখিলেশ ওঠে দাঁড়ায়। অচেনা মানুষের আগমনে গৃহস্থ ঠিক বুঝতে পারছিলনা কি বলবে। নিখিলেশেই বলে, সে জব্বার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। শুনে বৃদ্ধ যেন অবাক চোখে তাকালো। এরপর কি বলবে সেইটা বোধহয় অনেকক্ষণ ধরে গুছিয়ে তারপর বললো, আমিই তো।
সূর্যাস্তের সময়ে সূর্যকে দেখলে যেমন বিষণ্ন লাগে নিখিলেষের তেমন লাগতে শুরু করে। যেভাবে সে ভাবছিল জব্বার ভাইকে দেখেই হৈহৈ করে উঠবে। হাউমাউ করে কাঁদবে। ঠা ঠা করে হাসবে। তেমন কিছুই হওয়ার মত অবস্থা তাদের নেই। কি বলবে তালগোল পাকিয়ে যায়। নিখিলেশ তবু নিজের নাম ও মনে করিয়ে দেয়ার জন্য যে পরিচয়টি সে বহন করছে সেটি বলে।
এও জানায়, মৃত্যুর আগে নিখিলেশের বাবা বলে গেছেন, ভিটে ও বিজয়াটকিজের একটু মাটি যেন তার নামে গঙ্গায় ভাসায়।তার বাবা অপেক্ষা করছে স্বদেশের মাটির। নিখেলেশ সেই জন্যেই এসেছে।সব শুনে জব্বার ভাই শুধু মাথা নাড়ে। তাকে আদতে চিনতে পারলো কিনা তা স্পষ্টতর হয়না। সব কথা শুনে হুম ছাড়া কিছুই বলে না। জব্বার মিয়ার ভ্রুর নীচে চোখদুটো ঢাকা পড়ে গেছে। ভ্রুর থেকে চোখ যেন খাঁদে পড়ে গেছে।সেই খাঁদের নিচে সে কি ভাবছে পড়াও যাচ্ছেনা।
জব্বার ভাইয়ের কাছে নিখিলেশ মূলত যে কারণে ছুটে এসেছে সে কথাটা গলার কাছে আটকে আছে। কিছুতেই তা বলবার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা। তাকে সেকথা আর বলা যায় কিনা সেটিও বুঝে উঠতে পারছে না। তবু নিখিলেশ কথা বলে। জব্বার ভাই তার কাঁপাকাঁপা গলায় বলে, বাসার সবাই বালাতো? আসবা খবরটবর তো দিয়া আসলানা!
এরপর আবার ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে মেঝের দিকে। এমন সময় মেয়েটি ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকে। পিছন পিছন আসে একুশ কি বাইশ বছরের একটি মেয়ে। পরিচারিকার হাত থেকে ট্রেখানা নিয়ে নিখিলেশের সামনে রাখে। তারপর খুব পরিচিত মানুষের মত বলতে থাকে আপনি কি নানাভাইয়ের বন্ধু? দুলু কি কি বলছিল সব ভালো বুঝতেও পারিনাই। নানার বয়স হয়েছে। আগের কথা কিছুই মনে করতে পারেনা। এক কথা থেকে অন্য কথায় চলে যায়। ভুলভাল বকে। কোন দরকার না এমনিতেই বেড়াতে এসেছেন?
নিখিলিশের মুখ থেকে কোন কথা বেরোয় না। সে চমকে উঠে। মেয়েটির মুখটিতে কি মায়া। যেন নিখিলেশকে সে কতদিন চিনে। কথার খৈ ফুটছে। ললিত ভঙ্গী। ডাগর ডাগর চোখ দুটো থেকে হাসি ঠিকরে বেরুচ্ছে। ঝাপসা একটা মুখের মত। নিখিলেশ অপ্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এরপর এমনিতেই এসেছিল দেখতে বলে দ্রুত বের হয়ে আসে।
আকাশে তক্ষুনি অমাবস্যার চাঁদটি উঠেছে। একটি মৌটুসি পাখি চালতা গাছের ডালে বসে আছে। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করা গেল না ওর চোখের কোণে ছলকে ওঠা ছায়াটা জল না চাঁদের আলো!